আরজি করের ঘটনার ন্যায়বিচার নিয়ে রাজপথে আন্দোলন টানা তিন মাস ধরে চললেও নারী সুরক্ষা এখনো অধরা পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায়।
জয়নগর, মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, পুরুলিয়ার পর এবার উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। নারী নির্যাতনের ছবিটা সর্বত্র একই। কখনো নাবালিকা শিশু, কখনো কিশোরী ছাত্রীরাই থাকছেন নিশানায়। পরপর নারী নির্যাতনের ঘটনা দেখা গিয়েছে আলিপুরদুয়ারে। প্রথমে একজন শিশুকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। তারপর নয় বছরের বালিকাকে ফের ধর্ষণ। তার রেশ কাটতে না কাটতেই সোমবার আলিপুরদুয়ারের কামাখ্যাগুড়ি পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় এক একাদশ শ্রেণির ছাত্রী বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই নাবালিকা পড়ুয়া যখন রোববার বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ টিউশন পড়তে যাচ্ছিলেন, তখন এক অপরিচিত যুবক তাকে নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে যায়। নাবালিকাকে ধর্ষণের পর মোটরবাইকের চাবি তার গোপনাঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে নির্যাতন চালায়।
এই নৃশংস ঘটনার পরেই তাকে স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। রবিবার রাত একটা নাগাদ জেলা হাসপাতালে ওই ছাত্রীর জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হয়। ঘটনায় পরিবারের তরফে কামাখ্যাগুড়ি পুলিশ ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। গত বছর মাটিগাড়ায় জঙ্গলের ভেতর একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। ধর্ষণের সময় নির্মম শারীরিক অত্যাচারের জেরে মৃত্যু হয় ওই নাবালিকার। এমনকী পরিচয় গোপন করতে নির্যাতিতার মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়।
রাজ্য শিশু অধিকার আয়োগের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস ডিডাব্লিউকে বলেন, “এসব ক্ষেত্রে নিজেরাই উদ্য়োগী হয়ে পদক্ষেপ নিই। পকসোর অধীনে মামলা করা হয়েছে। আলিপুরদুয়ারে পরপর কতগুলি ঘটনা ঘটে গেল। ডিএম এবং এসপি তৎপরতার সঙ্গে সেগুলি দেখছেন।”
একের পর এক অপরাধ
মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, “আরজি করের ঘটনায় সরকারের ভূমিকা দুষ্কৃতীদের কাছে বার্তা দিচ্ছে যে কেউ অপরাধ করলেও প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সরকারই তাকে রক্ষা করবে। মানুষের কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে সরকার সবকিছু ধামাচাপা দিতে চায়। অপরাধীর কোনো সাজা হয় না। বিচার হয় না। নিন্দনীয় ভাবে আরজি কর কাণ্ডে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের ক্ষেত্রেও প্রিজন ভ্যান চাপড়ানো, তাকে কথা বলতে না দেয়া সেদিকেই আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।”
পুরুলিয়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত একের পর এক জেলায় নারী নির্যাতনের ঘটনা কেন চোখে পড়ছে এতো বেশি?
রঞ্জিত বলেন, “যে কোনো সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, তার যাই রূপ হোক না কেন, সমাজতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র বা বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামো, অপরাধ করলে তার সাজা অপরাধীকে পেতেই হবে। এই ধারণাটাই সমাজ থেকে চলে গিয়েছে। প্রভাবশালীর সঙ্গে থাকলে এই সমাজ ব্যবস্থা তাকে বাঁচিয়ে দেবে, এই বার্তা দুষ্কৃতীদের কাছে ভয়ংকর ভাবে পৌঁছে গিয়েছে। তারই বহিঃপ্রকাশে এই ধরনের লাগাতার কিশোরী, ছাত্রী, নাবালিকার নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শাসক দলগুলি যদি নিজের নীতি, কার্যক্রম না বদলায় তাহলে এর থেকে বেরোনো কঠিন।”
মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, “অপরাধ আটকাতে হলে দরকার সক্রিয় প্রশাসন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরকার ঘটনা ঘটলে প্রথমেই অস্বীকারের রাজনীতি শুরু হয়। সরকার বলে এখানে কিছু ঘটেনি। নির্যাতিতার উপরই অপরাধের দায় তুলে দেয়া হয়। এটা আমরা প্রথম থেকে ঘটতে দেখেছি পার্ক স্ট্রিট থেকে পরপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে।”
বলা হয়, সাহিত্য সমাজের আয়না। সাহিত্যের হাত ধরে সমাজের উত্তরণ ঘটে। বর্ষীয়ান সাহিত্যিক বাণী বসু ডিডাব্লিউকে বলেন, “আজকাল সাহিত্য তো মানুষ পড়ছেই না। সাহিত্য পড়ে তার দ্বারা প্রভাবিত হতে গেলে মানুষকে একটা স্তর পর্যন্ত উঠতে হবে। মানুষ তো সেই স্তরে উঠছেই না।”
কেন এই নিষ্ঠুরতা? সাহিত্যিক বলেন, “হয়তো মানুষ বঞ্চিত হতে হতে এরকম ভাবে রেগে উঠছে। অনেক কিছু মানুষ পাচ্ছে না। তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তারপর শিক্ষাদীক্ষা নেই। এসব মিলিয়ে কি হিংসা, ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে মানুষের মধ্যে? বুঝতে পারছি না কেন এত অমানুষিক অত্যাচার বেড়ে গেল! যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের দিক থেকেই সমাজের এই ময়লাগুলো আসছে। এটা ক্ষমতার দোষ বলেই মনে হয়।”
আরজি কর আন্দোলন ও নারী সুরক্ষা
জুনিয়র ডাক্তাররা মূলত নারী সুরক্ষার দাবিতেই রাস্তায় নেমেছিলেন। ১০ দফা দাবির মধ্যে নিহত চিকিৎসকের বিচার ছিল অন্যতম। সেই প্রসঙ্গে রণদীপের বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গে সরকার অপরাধীদের আড়াল করার ভূমিকা নেয়। আরজি করের ঘটনায় বিষয়টা সাধারণ মানুষের সামনে চলে এসেছে। একদিকে সাধারণ মানুষ প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অপরদিকে অপরাধীরা এই বার্তা পাচ্ছেন যে, যা খুশি করলেও কেউ না কেউ সামলে নেবে। এটা ভয়াবহ আরাজক পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই রাস্তায় নেমেছিলেন। শুধুমাত্র আরজিকরের জন্য নয়, দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক ঘটতে থাকা অন্যায়ের প্রতিবাদেই তারা একত্রিত হয়েছেন।”
‘মেয়েদের উপর নির্যাতন নতুন কোন কথা নয় এখানে’
তিনমাস ধরে কলকাতার রাজপথে ক্রমাগত মিছিল ও রাত দখলের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তাতে অবস্থা পাল্টায়নি কেন?
রঞ্জিত বলেন, “সিঙ্গুর, লালগড়, নন্দীগ্রাম এই আন্দোলনগুলো যখন চলছিল, তখন সমাজে এই ধরনের অপরাধ কমে গিয়েছিল। সংঘর্ষ অনেক তীব্র থাকায় সেখানে অপরাধীরা ভয়ে ছিল। বিরাট জমায়েত হয়েছে আরজি করে, কিন্তু সরকারকে নড়ানো যায়নি একেবারে। তিন মাস ধরে আন্দোলন করে সেই জায়গাটাতেই তো কোন বদল ঘটেনি। ছয়টা নির্বাচনে সরকারের জেতার সম্ভাবনা আছে, এই ভোট পলিটিক্সটাও সরকার জানে।”
অপরাধ প্রতিহত করার উপায়
তুলিকা বলেন, “এই ঘটনা যাতে বন্ধ করা যায়, সে জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছি আমরা। স্কুলগুলিতে প্রথম নজর দিয়েছি। সকলে মিলে অর্থাৎ সরকারি দপ্তর, বেসরকারি অফিস পাশাপাশি কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে সার্বিকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। দ্রুত দোষীকে ধরা এবং প্রমাণিত হলে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দান এর একমাত্র উপায়। এক বছরের মধ্যে অনেকগুলো মামলার শাস্তি হল শিলিগুড়িতে, মাটিগাড়ায়।”
তুলিকা জানিয়েছেন, ”পকসো এমন একটা বিষয় যেখানে কোনো মাফ হয় না, জামিন অযোগ্য অপরাধ প্রমাণিত হলে আর কোনো দিকে কেউ তাকাবে না। বিচার বিভাগও খুব কঠোরভাবে এটায় হস্তক্ষেপ করেন। আমাদের আরো তৎপর হতে হবে, আরো স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হচ্ছে।”
মোহিত রণদীপ মনে করেন সরকারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে গণমাধ্যমগুলিকে। তিনি বলেন, “মেয়েদের উপর নির্যাতন নতুন কোন কথা নয় এখানে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন ৯০ টা ধর্ষণ ভারতে ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে সেই তথ্য পাওয়া যায় না। গণমাধ্যমগুলিতে এসব নিয়ে আলোচনা হয় না। এই ঘটনাগুলো ঘটার পর সমাজমাধ্যম বা গণমাধ্যমগুলি যদি দায়িত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তুলে ধরেন এবং চাপ তৈরি করে, তাহলে মানুষ এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর একটা জায়গা খুঁজে পাবে। মানুষ সরকার বা বিচার ব্যবস্থার উপর আর ভরসা রাখতে পারছে না। একদিকে স্থানীয় প্রশাসন, রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকার, এবং বিচারব্যবস্থা, অপরাধীরা এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যদিকে অসহায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।”
আপনার মতামত জানান
সুত্রঃ ডয়েল ভেচ