পাঁচ বছর সংসার করার পর আর যেন পেরে উঠছিলেন না লিনা (ছদ্ম নাম)। স্বামীর অপমান, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একটা পর্যায়ে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। একটি সন্তানের মুখ চেয়ে অনেক সহ্য করেছেন। বাবার বাড়ির লোকজন বলেছেন আমাদের সমাজে একটা ডিভোর্সি মেয়েকে সহজভাবে নেয় না। একটি বাচ্চার ভবিষ্যতও অন্ধকার। মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করা যায়, কিন্তু শারীরিক নির্যাতন আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই এক দিন মহিলা পরিষদে আসেন লীনা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রথমে তাদের স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে থাকার জন্য কিছু পরামর্শ দেয়। কিন্তু পরে আর তারা একসঙ্গে থাকতে চান না। পরে সিদ্ধান্ত হয় ডিভোর্সের।
লিনার মতো শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নেন তালাকের। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনি সুরক্ষা বিভাগের অ্যাডভোকেট দিপ্তী সিকদার বলেন, বর্তমান সময়ে তারা এমন অনেক অভিযোগ পান যেখানে স্বামী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে। আবার স্ত্রী চাকরি করলে তার বেতনের টাকা নিয়ে নেন। নিজে স্ত্রীর ভরণপোষণ দেন না, সন্তানের দায়িত্বও নেন না। দাম্পত্য কলহের জের ধরে হত্যাকাণ্ডও ঘটে থাকে অনেক সময়।
সরকারি বেসরকারি হিসেব মতে, নারীরা বাড়িতেই বেশি নির্যাতনের শিকার। পুলিশ পরিচালিত জাতীয় জরুরি সহায়তা হেল্প লাইন ৯৯৯-এ চলতি বছর ১০ মাসে ৮৩৯টি নারীকে হত্যার তথ্য পাওয়া যায়। সরকারি ও বেসরকারি তথ্য মতে, দেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর তথ্য মতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফোন কলের ভিত্তিতে ৯ হাজার ৭১৪টি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্যাতনের ঘটনার সেবা প্রদান করা হয়। এ সময় ৮৩৯ জন নারীকে হত্যাজনিত ফোন কল পাওয়া যায়। গত ১০ মাসে ৯৯৯-এ ১ হাজার ৭৯টি নারী নির্যাতন বিষয়ক সেবা দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘নারী-কন্যার সুরক্ষা করি, সহিংসতামুক্ত বিশ্ব গড়ি’ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে পালিত হচ্ছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। আজ থেকেই নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে ১৫ দিনব্যাপী পালন করা হবে নারী নির্যাতন পক্ষ।
পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর পরিদর্শক মো. আনোয়ার সাত্তার বলেন, প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজারেও অধিক কল পান তারা। সর্বোচ্চ যে বিষয় কল আসে তা হলো নারী নির্যাতন। এখন নির্যাতন বাড়ছে আবার অভিযোগের জায়গাটাও তৈরি হচ্ছে। আগে মধ্যরাতে একজন নারী তার স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হলে তাৎক্ষণিক অভিযোগের সুযোগ ও জায়গা ছিল না। এখন অভিযোগ করে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জায়গাটাও আছে। আমরা যত ফোন কল পাই তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
কিছু ঘটনা : চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় ভাত রান্না করতে দেরি হওয়ায় স্ত্রীকে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ইয়াসিন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ২৫ অক্টোবর সকালে উপজেলার ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নের ধনাগোদা নদীর নবুরকান্দি বেড়িবাঁধের সঙ্গে টেম্পুস্টেশন নদী থেকে ফেরদৌসী আক্তার আন্না নামে ঐ নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ইয়াসিন নামে ঐ ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ। ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্লবীতে পারিবারিক কলহের কারণে নিজ বাসায় স্ত্রীকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় গিয়ে হাজির হন স্বামী মোখলেছুর রহমান।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, পারিবারিক সুরক্ষা আইন সম্পর্কে মানুষ সেভাবে জানে না। অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে অনেক সময় লাগে। নির্যাতনের শিকার হলে নারীর মামলা অন্যভাবে লেখা হয়। এমন নানা কারণে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। প্রস্তাবিত নারী অধিকার কমিশনের প্রধান এবং নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক বলেন, সমাজে ন্যায়পরায়ণ মানুষের অভাবের কারণে নিজ গৃহে নারী বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। তারা নারীকে ‘মানুষ’ ভাবে না। নারী নির্যাতন বন্ধ করতে সমাজে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
নারী নির্যাতন বন্ধে করণীয় হিসেবে ইদানীং যে বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হচ্ছে নারী নির্যাতন বন্ধে কেবল নারীর সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, বরং পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারী নির্যাতনের মাশুল শুধু নারীরাই দেন না– গোটা পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকেও পিছিয়ে পড়তে হয় অনেক। যে পরিবারে নারী নির্যাতন হয় সে পরিবারের শিশুরা শিক্ষা-দীক্ষা ও সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়ে। নারী নির্যাতনের অর্থনৈতিক খেসারতও কম নয়। নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোর মাথাপিছু আয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হওয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ– ওইসব দেশে নারী নির্যাতনের হার কম। তাই সেখানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন আর পরিবার ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে রাখতে পারেন সমান অবদান।
সুত্র: দৈনিক ইত্তেফাক