ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সুযোগসন্ধানীরা থানা, ফাঁড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বিপুল অস্ত্র, গুলি লুট করেছে। এসব লুটের অস্ত্র এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি। এ ছাড়া বিগত সরকার পতনের আগে-পরে দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গিসহ দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বন্দিরা পালিয়ে গেছে। তাদেরকেও দেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে লুট হওয়া অস্ত্র দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া, আন্দোলনের সময় কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেছেন তারা। বিশ্লেষকদের মতে, লুণ্ঠিত অস্ত্র অপরাধে ব্যবহৃত হয়ে দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। পলাতক দুর্ধর্ষ বন্দিরা আবারও খুন, সন্ত্রাস ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
পুলিশসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি বেশিরভাগই পেশাদার অপরাধীচক্রের হাতে চলে গেছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতেও এই অস্ত্র পৌঁছেছে। এমনকি লুণ্ঠিত অস্ত্র সুন্দরবন এলাকার জলদস্যুদের, তিন পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন অপরাধী গ্রুপের কাছে এবং আরও অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে চলে গেছে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এই অস্ত্রগুলো অপরাধমূলক কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর বেচাকেনা চলছে। এসব বেহাত অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষত র্যাব ও পুলিশের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত শনিবার মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে প্রেমিকা শাহিদা ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করেন কথিত প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়। এই খুনে ব্যবহৃত পিস্তলটি গ্রেপ্তার তৌহিদ গত ৫ আগস্ট ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করেছিলেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২২ আগস্ট নরসিংদীর রায়পুরার শ্রীনগর ইউনিয়নের সায়দাবাদ এলাকায় সাবেক ইউপি সদস্য ফিরোজ মিয়া ও আবু হানিফ জাকারিয়ার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে প্রতিপক্ষের গুলিতে ফিরোজের অনুসারী ছয়জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হন। নিহত আমির হোসেনের ছেলে আজগর হোসেন জানিয়েছেন, নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র পলাতক আসামিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন আবু হানিফ জাকারিয়া ও নজরুল ইসলাম। সেই অস্ত্র দিয়েই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়।
শুধু এ দুটি ঘটনাতেই নয়, লুণ্ঠিত অস্ত্র আরও নানা অপরাধে ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্র উদ্ধার করতে তারা তৎপর রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে গত ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। এখনও ১ হাজার ৪১৯টি লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদের মধ্যে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৫৬টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। এখনও ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৫৩টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে চাইনিজ রাইফেল ১ হাজার ১০৬টি লুট হয়। এর মধ্যে উদ্ধার হয় ৯৭৭টি। এখনও উদ্ধার হয়নি ১২৯টি। ১২ বোরের শটগান লুট হয় ২ হাজার ৭৬টি। উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ৬৫৯টি। এখনও ৪১৭টি শটগান উদ্ধার হয়নি। ৯এমএম পিস্তল লুট হয় ১ হাজার ৯২টি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৬২০টি। এখনও ৪৭২টি ৯এমএম পিস্তল উদ্ধার হয়নি। লুট হওয়া ৫৩৯টি চাইনিজ পিস্তলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩১৮টি। এখনও ২২১টি চাইনিজ পিস্তল উদ্ধার হয়নি।
লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর দৈনিক আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের সাবেক ডিআইজি মেজবাউন নবী বলেন, একটি অবৈধ অস্ত্রের অস্তিত্ব পুলিশের জন্য মাথাব্যথার কারণ। তাই আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি।
এদিকে গতকাল বুধবার কারা অধিদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেছেন, জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে গিয়েছিল। এই বন্দিদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা ছিলেন। পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জন ফিরে এসেছে। তবে বর্তমানে ৭০০ জন পলাতক রয়েছে, যাদের মধ্যে ৭০ জন অতিঝঁকিপূর্ণ, যেমন- জঙ্গি, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী।
কারা মহাপরিদর্শক আরও জানান, বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা প্রায় ৪২ হাজার বন্দির। তবে ৫ আগস্টের আগে বন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। সরকার পরিবর্তনের পর জামিন হওয়ায় বন্দির সংখ্যা কমে ৫৫ হাজারে নেমে আসে, কিন্তু বর্তমানে এটি বেড়ে ৬৫ হাজারে পৌঁছেছে। এক প্রশ্নের জবাবে মোতাহের হোসেন বলেন, সরকার পতনের পর জামিনে মুক্ত হওয়া আসামিদের মধ্যে ১৭৪ জন জঙ্গি এবং ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছে।
সুত্র: আমাদের সময়