জেল ভেঙে পালানো ৭৮ জন জঙ্গি আসামি এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সারাদেশের ৮ টি কারাগারে কয়েদী ও হাজতীরা বিদ্রোহ করে। এদের মধ্যে ৮৮ জন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিও পালিয়ে যায়। পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ ও র্যাবের হাতে ধরা পড়ে। বাকি ৮০ জন এখন ফেরারি।
কারাসূত্র জানায়, জঙ্গি আসামিদের মধ্যে কাশিমপুর কারাগার থেকে শতাধিক আসামি পালিয়ে যায়। এর মধ্যে এখনও ৭৮ জন আসামি অধরা রয়েছেন। গত ৬ আগস্ট সকালে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে কয়েদিদের মধ্যে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। কয়েদিরা কারা অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়ে মোট ১৯৯ জন পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ৮৮ জন রয়েছেন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ২০৩ জন আসামি আত্মসমর্পণ করেন, তবে বেশ কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কাশিমপুর কারাগারে দেশের অন্যান্য কারাগার থেকে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এনে রাখা হয় যাদের সকলেই পালিয়ে যান। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও র্যাবের হাতে ৮ জন আসামি গ্রেপ্তার হন।
এ ব্যাপারে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোঃ মোতাহের হোসেন বলেন, কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়, যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তারের পর ফের কারাবন্দি করা হলেও এখনো ৭০০ বন্দি পলাতক রয়েছে। ওই সময়ে আটটি কারাগার থেকে অস্ত্র লুট হয়েছিল ৯৪টি। এর মধ্যে ৬৫টি উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। ৫ আগস্টের আগে বন্দী ছিল ৫৫ হাজার। যদিও পরবর্তীতে সেই সংখ্যা কমে গিয়েছিল। এখন আবার গ্রেপ্তার চলছে। এখন বন্দী সংখ্যা ৬৫ হাজার।
পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পলাতক ৭শ বন্দীর তালিকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন শাখায় দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির কাছেও তালিকা দেয়া হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে।
কারা সূত্র জানায়, কোটা আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই বিক্ষোভকারীরা নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা করে। সেদিন কারাগারের মূল গেট ভেঙে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওই কারাগারে যারা কয়েদখানার লকার ভেঙেছে, তারা ১০-১২ জনের একেকটি গ্রুপে বিভক্ত ছিল। এরা কয়েদিদের মুক্ত করার পাশাপাশি ৯ জঙ্গিকে ছাড়িয়ে আনে। এ সময় কারাগারে থাকা ৮২৬ বন্দির সবাই পালিয়ে যায়। এরপর অস্ত্রাগারে থাকা ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজার ১৫০টি গুলি লুট করে। কয়েদখানা, রক্ষীদের ব্যারাক এবং কারা হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নথিপত্র।
নরসিংদী জেলা কারাগারের জেল সুপার শামীম ইকবাল বলেন, নরসিংদী জেলা কারাগারে বিদ্রোহের পর সব আসামি- ৮২৬ জনই পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে আত্মসমর্পণ করে ও গ্রেপ্তার করা হয় ৬১১ জনকে। পলাতকদের মধ্যে ৭ জন সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামি ছিলেন। এর মধ্যে ৫ জন গ্রেপ্তার হলেও বাকি দুই জনকে এখনও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে কারাগারের কোন কাগজপত্র নেই বলে পলাতক প্রকৃত আসামির সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। ওই ৬১১ জনের মধ্যে একটা বড় অংশ কাশিমপুর কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেও ৬ আগস্ট কিছু আসামি পালিয়ে গেছে। তবে নরসিংদী জেলা আদালতের কাছ থেকে নেওয়া কাগজপত্র এখনও যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। সেটা শেষ হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এখন পর্যন্ত কতজন আসামি এই কারাগারের পলাতক রয়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা বলেন, ৫ আগস্টের পর এই কারাগার থেকে মোট ৮৭ জন আসামি পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযানে ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখনও ৫৩ জন পলাতক রয়েছেন। পলাতকদের মধ্যে ২ জন রয়েছেন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। এর মধ্যে ৫১ জন পুরুষ ও ২ জন নারী কয়েদি রয়েছেন।
কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের জেল সুপার আব্দুর রহিম বলেন, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়া কারাগার থেকে মোট ৯৮ জন বন্দী পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ২ জন সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামিও রয়েছেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন অভিযানে পলাতকরা গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত ২৪ জন কয়েদি অধরা রয়েছে।
শেরপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির খান বলেন, ৫ আগস্ট বিকালে শেরপুর জেলা কারাগারে প্রধান ফটক ভেঙে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এ সুযোগে ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যান। তাদের মধ্যে ১০৩ জন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন আর ৪৬ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে। এখনো পলাতক ৩৬৯ বন্দি। এখনো ৮৪৪টি চাইনিজ রাইফেলের গুলি এবং শটগানের ২৯৯টি গুলি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে কারা সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর সারাদেশের ৮টি কারাগার বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ টি কারাগার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো হলো কাশিপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার, নরসিংদী জেলা কারাগার, কুষ্টিয়া জেলা কারাগার, সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ও শেরপুর জেলা কারাগার।
সুত্রঃ ইত্তেফাক