বাংলাদেশে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির বাজার না থাকলেও এখানে সক্রিয় রয়েছে আন্তর্জাতিক চক্র। দেশে চলতি বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের মূলহোতা এবং তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ বছরের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের আরও এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছে, বহির্বিশ্বের মতো দেশে শিশু পর্নোগ্রাফির বাণিজ্যিক বাজার নেই, তবে সক্রিয় রয়েছে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্র। এ অবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) বাংলাদেশের শিশু পর্নোগ্রাফির ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। ইন্টারপোলের পাশাপাশি ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লোয়েডেড চিলড্রেন (এনসিএমইসি)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংস্থা দুটির সঙ্গে পুলিশ বিভাগ একাত্মভাবে কাজ করছে। এরা পুলিশ বাহিনীকে বাংলাদেশে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির সঙ্গে জড়িত এবং এর ভুক্তভোগী শিশুদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। বিশেষ করে কোনো শিশু যদি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তা পুলিশ বাহিনীকে জানায় তারা। নিকটাত্মীয়ের হাতে কোনো শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে পুলিশ বাহিনী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সংশ্লিষ্ট শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে মামলা করতে আগ্রহী হন না অভিভাবকরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তিরাই শিশু পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধ করে থাকে। আবার যারা এগুলো দেখে তারাও মানসিকভাবে সুস্থ নয়। দেশে বহির্বিশ্বের মতো বাণিজ্যিকভাবে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি না হলেও কাছের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের দ্বারা অনেক শিশুই যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। দেশের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮ নম্বর সেকশনের সাব-সেকশন ১, ২, ৩-এ বলা আছে, কেউ শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আইনটি শিশু পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনুপযোগী বলে মনে করেন তাঁরা।
সিআইডি মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কেউ চাইল্ড পর্নোগ্রাফি নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করলেই যে ঢুকতে পারবে বিষয়টি এমন নয়। আর কেউ এগুলো খুঁজলেও কেউ না কেউ ওই ব্যক্তির ওপর ঠিকই নজরদারি করছে। কেউ এ ধরনের অপরাধ করে থাকলেও তার তথ্য আমরা পেয়ে যাই। আমাদের কাছে ইন্টারপোল থেকে কনটেন্ট আসে। এর মাধ্যমে নিয়মিত প্যাট্রলিং করি। ইন্টারপোলের সদস্যরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তথ্য নিয়ে আমাদের কাছে পাঠান। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে আমাদের কাছে তথ্য চাইলে আমরা সেই ব্যক্তির ব্যাপারে তদন্ত করে তা ইন্টারপোলকে দিই। আবার ইন্টারপোলও যদি এ ধরনের কোনো সন্দেহজনক তথ্য পায় তা আমাদের জানায়। আমরা একসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করি। এ ক্ষেত্রে এনসিএমইসি কর্তৃপক্ষও আমাদের সহযোগিতা করে।’ রেজাউল মাসুদ আরও বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় কাছের আত্মীয়ের মাধ্যমেই শিশুরা নিগৃহীত হয়। এদের মধ্যে চাচা, মামা, ফুপার মতো আত্মীয়রাও আছেন। আমরা একটি শিশুকে পেয়েছি যে তার ফুপা-ফুপুর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। শিশুটির ফুপা-ফুপু ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা নিজেদের কাছেই রেখে দিয়েছিল। এজন্য ছেলে বা মেয়ে হোক কোনো শিশুকেই কখনো মা-বাবা ছাড়া অন্য কোথাও রাতযাপন করতে দেওয়া যাবে না। আর রাখলেও নজরে রাখতে হবে। এমন অনেক শিশু আছে যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে কিন্তু তাদের ঘটনা অজানাই থেকে যাচ্ছে। শিশুদের ভয়ভীতি দেখালে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও মা-বাবাকে বলার সাহস করে না। এ বিষয়ে শিশুদের সঙ্গে মা-বাবার খোলামেলা কথা বলতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানদের বোঝাতে হবে, কেউ যদি তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তাহলে তা চেপে না রেখে মা-বাবাকে যেন খুলে বলে।’
এদিকে দেশে শিশু পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের বাংলাদেশের মূলহোতা এবং তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তাদের কাছ থেকে নগ্ন ছবি, ভিডিওসহ বিপুল পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট জব্দ করা হয়। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম জব্দসহ এক শিশু ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে এ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন টি আই এম ফখরুজ্জমান ওরফে টিপু কিবরিয়া এবং তাঁর সহযোগী মো. কামরুল ইসলাম ওরফে সাগর। ২০০৫ সালে শিশু পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও বিতরণের সঙ্গে জড়ান টিপু কিবরিয়া। দীর্ঘদিন এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পর ২০১৪ সালে সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হন। পরে তাঁর নামে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়। ২০২১ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কিছুদিন সাহিত্যচর্চা করলেও আবারও শিশু পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পথশিশুদের অর্থের লোভ দেখিয়ে টিপু বাসায় ডেকে নিজের ক্যামেরার সাহায্যে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নগ্ন ছবি, শরীরের বিভিন্ন গোপনাঙ্গের ছবি তোলেন এবং ভিডিও করেন। প্রাথমিকভাবে তাঁর ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো থেকে প্রায় ২০ পথশিশুর ছবি ভিকটিম হিসেবে শনাক্ত করা হয়। টিপু ছাড়াও দেশিবিদেশি শিশু পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট সংগ্রহ ও সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে বিক্রি বা প্রদর্শনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সক্রিয় এক সদস্যকে গত জুলাইয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গাজীপুরের টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকা থেকে মো. সবুজ হোসেন নামে এ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সবুজ নিজের পরিচয় গোপন করে হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে দেশিবিদেশি শিশু পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট সংগ্রহ করে তা বিক্রি বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করতেন।
সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন