পার্সটুডে-ব্রিটেনে নারীদের ওপর সহিংসতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক সংকটে পরিণত হয়েছে। দেশটির দৈনিক গার্ডিয়ান ২০২৪ সালে ৮০ জন নারী হত্যার বিষয়ে তদন্ত সম্পর্কে লোমহর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
ওই রিপোর্টে দৈনিকটি লিখেছে, ব্রিটেনের এই সংকট এখনও বেশ তীব্র ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। ইরনার বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, গার্ডিয়ানের ওই রিপোর্ট কেবল এক বিশাল বা বিস্তৃত সংকটের অংশ-বিশেষ মাত্র এবং সরকারি পরিসংখ্যানগুলোও তা তুলে ধরছে।
ব্রিটেনের পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে প্রতিদিন একজন নারী পুরুষের হাতে নিহত হচ্ছে। কিন্তু কেন এই সংকট এতটা তীব্র এই দেশটিতে?
এ সংকটের নানা কারণ ও পটভূমি
ব্রিটেনের বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী সারা জনসন এই সংকটের কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন: ব্রিটেনে নারীর ওপর সহিংসতার সংকটের মূল লৈঙ্গিক বৈষম্যের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত যা ব্রিটেনের আধুনিক সমাজে এখনও দৃশ্যমান। তিনি আরও বলেছেন, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি ঘরোয়া সহিংসতাসহ নারীর বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধের চলক বা নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহলাসক্তিও এ জাতীয় সহিংসতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হত্যাকাণ্ডের নানা ঘটনায় এটা প্রমাণ হয়েছে যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেনে যেসব বিষয় এইসব ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেসবের মধ্যে মাদকাসক্তিও অন্যতম।
ব্রিটেনের অপরাধ-মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেমস রিচার্ডসন মনে করেন মাদকাসক্তির যে সামাজিক ও মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব তা বিশেষভাবে ঘরোয়া পরিবেশে সহিংসতা সৃষ্টির মত উত্তেজনা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হ’ল সহিংসতা মোকাবেলায় শিক্ষা এবং জনসচেতনতার অভাব। যুক্তরাজ্যের নারী অধিকার কর্মী এমিলি স্টুয়ার্টের মতে, “শৈশব থেকে স্কুলে শিক্ষা এবং সমাজে শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তোলা নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে৷দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না। যুক্তরাজ্যের বিচার ব্যবস্থায় অদক্ষতা এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি সমর্থনের অভাব অন্যান্য বিষয় যা বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাজ্যে গার্হস্থ্য এবং যৌন সহিংসতার শিকার অনেক ব্যক্তি সহিংসতার রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকেন কারণ তারা বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখেন না।
গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকারদের পক্ষের আইনজীবী এলিজাবেথ ম্যাকার্থি বলেছেন: “দীর্ঘ ও জটিল বিচারিক প্রক্রিয়া, মানসিক ও সামাজিক সমর্থনের অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে, একই সহিংস পরিবেশে ভুক্তভোগীদের প্রত্যাবর্তন অনেক নারীকে তাদের মামলা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। ফলে এ জাতীয় সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে উপরন্তু অপরাধীদের জবাবদিহি করার সম্ভাবনাও হ্রাস পেয়েছে।”
তার মতে, যুক্তরাজ্যে আরেকটি গুরুতর সমস্যা হল সহায়তা পরিষেবা প্রদানের জন্য সম্পদ-সংস্থান এবং বাজেটের অভাব। অনেক সহায়তা কেন্দ্র যারা ভুক্তভোগীদের পরামর্শ এবং অস্থায়ী বাসস্থানের মতো পরিষেবা প্রদান করে বাজেটের ঘাটতির সম্মুখীন। এটি অনেক ভুক্তভোগীকে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন করছে। ঐতিহ্যগত কারণগুলোর পাশাপাশি, নতুন প্রযুক্তি নারীর প্রতি সহিংসতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে যুক্তরাজ্যে ডিজিটাল গোয়েন্দাবৃত্তি এবং সাইবার হয়রানি-এর মতো ঘটনা তীব্র মাত্রায় বাড়ছে।
গার্হস্থ্য সহিংসতার উপর প্রযুক্তির প্রভাবের গবেষক ক্লেয়ার অ্যান্ড্রুস বলেছেন: “প্রযুক্তি অপরাধীদের তাদের শিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং হয়রানির জন্য উন্নত সরঞ্জাম ব্যবহার করতে দেয়৷ ট্র্যাকিং সফ্টওয়্যার, ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টে হ্যাকিং এবং এমনকি অনলাইন হুমকিও নারীদেরকে নতুন ধরনের সহিংসতার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতার সংকট শুধু ভুক্তভোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি পরিবার, শিশু এবং সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ সমাজকেও প্রভাবিত করে। যদিও এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এই ব্যবস্থাগুলি অপর্যাপ্ত, এবং দ্রুত ও গুরুতর পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া এই দুঃখজনক পরিসংখ্যানগুলো চলতেই থাকবে।#
সুত্র: পার্সটুডে