মধ্যবয়সী এক নারীর ফেসবুকে পরিচয় হয় আশরাফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির। পরিচয়ের ৬ মাস পরে তাদের মধ্যে তৈরি হয় বন্ধুত্ব। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। নিয়মিত ভিডিও কলে কথা হয় ম্যাসেঞ্জারে। কিছুদিন না যেতেই ওই নারীকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন আশরাফুল। কথোপকথনের একপর্যায়ে সে স্ক্রিন রেকর্ডারের মাধ্যমে ভুক্তভোগী ওই নারীর অশ্লীল ভিডিও ও ছবি ধারণ করে রাখে মোবাইলে। পরে এসব ভিডিও ও ছবি ওই নারীর কাছে পাঠায়। ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলে নানা ধরনের হুমকি দেয়া হয়। ভুক্তভোগী নারী পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুক পেজে অভিযোগ করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
শুধু ভুক্তভোগী এই নারীই নন, সাইবার স্পেসে প্রতিনিয়ত নানাবিধ হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। ভুক্তভোগী অনেক নারী বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথও। এ ধরনের অপরাধীরা অনেক সময় এসব ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় বড় অঙ্কের টাকা। গত ১ বছরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে ৯ হাজার ১৬৫ জন নারী প্রতিকার চেয়েছেন। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্যমতে, গত এক বছরে ভুক্তভোগী এসব নারীর ৪ হাজার ১৩৪ (৪৫ শতাংশই) ডক্সিংয়ের (বিনা অনুমতিতে স্পর্শকাতর ছবি-ভিডিও, তথ্য প্রভৃতি প্রকাশ করা) শিকার হয়েছেন। ইমপার্সোনেশন ৫৩০ (৬.০০ শতাংশ), আইডি হ্যাক ১ হাজার ৩৯৩ (১৭.০০ শতাংশ), ব্ল্যাকমেইলিং ১ হাজার ৭২৪ (১৮.০০ শতাংশ), সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ করেছেন ৮৭৩ (৯.০০ শতাংশ), আপত্তিকর কন্টেন্ট ছড়ানো ২৫৬ (৩.০০), মোবাইল হ্যারেসমেন্ট ২৪১ (২ শতাংশ) এবং অন্যান্য ১৪ জন। সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৯ হাজার ১৬৫ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়ে প্রতিকার চেয়েছেন।
সূত্র জানায়, ভুক্তভোগীদের তথ্য আদান-প্রদানে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয় সাপোর্ট সেন্টার থেকে। হয়রানির বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় এখান থেকে। এছাড়া ভুক্তভোগীকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার ও আইনগত পরামর্শও দেয়া হয়। সাইবার স্পেসে প্রতিনিয়ত নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক নারী লোকলজ্জায় আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেকেই সমাজে নানাভাবে অপমান-অপদস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে ফেসবুকে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে এক ধরনের প্রতারক নারীদের নানাভাবে হয়রানি করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগী নারীরা এসব বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ করছেন। অভিযোগের সূত্রধরে তারা এ ধরনের প্রতারকদের আইনের আওতায় আনছেন।
সম্প্রতি কণা নামের এক ভুক্তভোগী নারী পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে অভিযোগ করেন। তিনি জানান, গোপনে ধারণকৃত তার কিছু গোসলের ছবি কে বা কারা তারই নামে খোলা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি ফেইক আইডি থেকে তাকে পাঠিয়েছে। আইডিতে মেসেজ দিয়ে সেসব ছবি কীভাবে পেয়েছে ও আইডি পরিচালনাকারী ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। সে ছবিগুলো ডিলিট করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ভুয়া আইডি’র পরিচালনাকারী কণাকে জানায় যে, সে তার কাছেরই কেউ এবং কণা যখন গোসল করছিল তখন সে ছবিগুলো ধারণ করেছে। সে আরও জানায়, এসব ছবি সে ডিলিট করে দিতে রাজি আছে যদি কণা নিজের আরও কিছু আপত্তিকর ছবি এবং ভিডিও নিজে ধারণ করে তাকে পাঠায় কিংবা বড় অঙ্কের টাকা দেয়। এই প্রস্তাবে কণা রাজি না হয়ে আইনি আশ্রয় নেয়ার কথা জানায়। এতে অপরাধী ক্ষীপ্ত হয়ে কণার গোসলের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এ সময় কণা তার অভিভাবককে জানান এবং তার বাবাকে নিয়ে নিকটস্থ থানায় অভিযোগ করেন। ভুক্তভোগীর করা এ মামলায় পুলিশ কণার প্রতিবেশী রায়হানকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ বলেছে, ব্যক্তিগত আইডিকে সুরক্ষিত করতে হবে। নিজেদের আইডি সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব কিন্তু নিজের। অন্য কেউ একজন ঘরে গিয়ে কিন্তু সুরক্ষিত করতে পারবে না। প্রোফাইল লক করা, অথেনটিকেশন দেয়া, কয়েকটি ট্রাস্টের কন্ট্রাক্ট দেয়া এই বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে আগে। আইডিতে প্রবেশ করে কেউ যেন ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও ছবি করতে না পারে। প্রোফাইল যখন ওপেন থাকবে, ভার্চ্যুয়াল জগতে যখন সবকিছু ওপেন থাকবে তখনই এই হয়রানিগুলো সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর কিছু আচরণবিধি মানা দরকার- যেটি আসলে একটা বড় অংশ মানছে না।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী একজন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হন বা তাকে যখন নানাভাবে অসম্মানজনক মন্তব্য করা হয় অথবা ব্যক্তিগত ছবি ধারণ, অশ্লীল অডিও-ভিডিও ধারণ করে সেটিকে ছড়িয়ে দেয়া বা হুমকি দেয়া হয়। এটি ছড়িয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টাগুলো দেখি এর মধ্যদিয়ে কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় একজন নারী সামাজিক জীবনে নানা ধরনের ক্ষতি ও প্রশ্নের সম্মুক্ষিণ হন। যারা এই সাইবার স্পেসকে নিজের উদ্দেশ্যে বা অন্যকে হেয় করার জন্য ব্যবহার করে সেটি কখনো কখনো সমাজ জীবন বা ব্যক্তি জীবনের উপরে তার প্রভাবটা তারা তৈরি করতে চায়। এই ধরনের অপরাধী যারা তাদেরকে সাইবার অ্যাক্ট বা প্রচলিত আইনে বিচার করা সম্ভব যদি একজন অভিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার ও বন্ধুত্ব তৈরিসহ সব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা এবং সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৯ হাজার ১৬৫জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানি সংক্রান্ত যোগাযোগ করেছেন। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সুত্রঃ মানবজমিন