আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হয়েছিলেন কোলের দুই শিশুসহ অন্তঃসত্ত্বা নারী। দিনের পর দিন তাদের আটকে রাখা হয়েছিল চার দেয়ালের ভেতরে। অন্তঃসত্ত্বা ওই নারীকে মারধর করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুরুষ সদস্যা। আরেক নারীকে তার শিশু কন্যাসহ তুলে নেওয়া হয়েছিল র্যাব-২ সদর দফতরে। পরদিন ওই শিশুটিকে সড়কে ফেলে চলে যায় ওই বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীকালে একজন ইমাম তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেন। কিন্তু ওই নারী আর ফিরে আসেননি।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অগ্রগতি প্রতিবেদনে এমন ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। রবিবার (১৯ জানুয়ারি) গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেন। এসময় গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টাকে কথিত ও আলোচিত ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শনের আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টাও ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করবেন বলে জানিয়েছেন।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের জমা দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘গুমের শিকার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে পদ্ধতিগতভাবে বঞ্চিত হয়েছেন এবং গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা মিথ্যা মামলা, বিচার বিভাগের নিষ্ক্রিয়তা এবং সামাজিক কলঙ্কের মধ্য দিয়ে পুনরায় শোষণের শিকার হয়েছেন। একইসঙ্গে মানসিক, সামাজিক এবং আর্থিক প্রভাব ভুক্তভোগীদের সমাজে পুনর্বাসনকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে।’
অগ্রগতি প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারের ওপরও গুম-সংক্রান্ত প্রভাবের বিষয়ে বলা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি, হয়রানি এবং নজরদারির মুখোমুখি হতে হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট, আইনি জটিলতা এবং মানসিক চাপ তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্তানদের মাঝেও মানসিক আঘাত এসেছে। যদিও অনেকেই ভয়ভীতিকে পাশ কাটিয়ে নিয়মিত প্রতিবাদ করেছেন। তারা গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফেরত চেয়ে নানারকম কর্মসূচিও পালন করেছেন।
একটি পরিবারের উদাহরণ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রায় এক যুগ আগে গুম হওয়া এক ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তান কমিশনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। স্কুল ড্রেস পরা যে শিশুটি তাদের সামনে এসেছিলেন, তার ছয় বছর বয়সে বাবা গুমের শিকার হন। ওই ব্যক্তির স্ত্রী এখনও আশায় আছেন যে তার স্বামী ফিরে আসবেন। যদিও ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়েও তাদের শঙ্কা কাটেনি। এখনও তারা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গুমের শিকার ব্যক্তিরা জীবিত রয়েছেন, নাকি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন— তা নিয়েও পরিবারের সদস্যদের জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়। কারণ মৃত্যু সনদ বা যথাযথ তথ্য-প্রমাণ বা ডেডবডি ছাড়া গুমের শিকার ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব বা অন্যান্য সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়। সাত বছর অতিক্রান্ত না হলে এ বিষয়ে আদালতে যাওয়ারও সুযোগ নেই। আবার আদালত থেকে অনুমতি আসার পরও অনেকেই মৃত ঘোষণা মেনে নিতে পারেন না। অনেক নারী তার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করার জন্য আদালতেও যেতে চান না। ফলে ওইসব পরিবারকে অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যেও দিন পার করতে হয়।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘‘গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকারও হন। সমাজে তাদের ‘সন্ত্রাসীর পরিবার’ হিসেবেও ট্যাগ দেওয়া হয়। স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে বাসা ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে তাদের। এমনকি তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও নানাভাবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিপক্ষে ক্যাম্পেইন করা হতো।’’
অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নৈতিকতার ওপর প্রভাব ফেলেছে, যেখানে তারা অপরাধকে অপরাধ বলে মনে করে না। অনেক সদস্য তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জড়িত হতে বাধ্য হয়েছেন—যা তাদের পেশাগত গর্ব ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’
কমিশনের পক্ষ থেকে সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতর (ডিজিএফআই) এবং আলোচিত ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আয়নাঘর’ এবং ডিজিএফআইয়ের যেসব যৌথ জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো—সেসব দেয়াল নতুন করে রঙ করা হয়েছে। সেসব দেয়ালে অনেক আটক ব্যক্তি তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও পরিচয়ের কথা লিখে রেখেছিলেন।
গুম সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ডিজিএফআইয়ের ডিজিকে জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি নিজের দায় অস্বীকার করেছেন। তিনি গুম সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য আগে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়ী করেন।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘গুম সংক্রান্ত ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিম্নস্তরের সদস্যরা ‘হুকুমের গোলাম’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গুমের শিকার অনেক ব্যক্তি বলেছেন—নিম্নস্তরের সদস্যরা তাদের সঙ্গে নানা তথ্য শেয়ার করেছেন এবং নিজেদের অপারগতার কথা স্বীকার করেছেন। একজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ডিবির একজন সদস্য গুমের শিকার ওই ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চান, বলেন তার কোনও কিছু করার নেই। তিনি শুধু দায়িত্ব পালন করছেন।’’ আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘গুমের শিকার ওই ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে দুর্ঘটনার মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে সময় ওই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিম্নস্তরের সদস্য নিরুপায় ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি গুমের শিকার ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেন। যদিও সেই ঘটনায় গুমের শিকার ওই ব্যক্তি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন দোষীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনী, ভুক্তভোগী এবং জাতির মধ্যে বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের জন্যও কাজ করছে। যাতে এটি একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা যায়।’
সুত্রঃ মানবজমিন