সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড না থাকলেও দেশে জঙ্গিদের প্রায় সব সংগঠনই কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় আছে। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে প্রতিটি সংগঠন সদস্য সংগ্রহসহ নানা তৎপরতা চালু রেখেছে। এর মধ্যে আলোচিত তিনটি জঙ্গি সংগঠনের দুটি পরিচালিত হচ্ছে বিদেশ থেকে। অপর সংগঠনের নেতারা দেশের ভেতরেই আছেন। ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলার পর থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কোণঠাসা অবস্থায় আছে। আজ ওই হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধে যুক্ত বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে যে তিনটি আলোচিত, সেগুলো হলো আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী নব্য জেএমবি এবং আল–কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণকারী জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম। জেএমবি ও নব্য জেএমবির মূল নেতারা বিদেশে থেকে সংগঠন পরিচালনা করছেন। আনসার আল ইসলামের নেতারা দেশেই আছেন বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে হামলায় অভিযুক্ত জঙ্গিরা ছিলেন নব্য জেএমবির সদস্য। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের (ইসলামিক স্টেট) উত্থান ছিল তখন এই জঙ্গিদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। হোলি আর্টিজানের ওই হামলায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ জন নিহত হন।
জেএমবি-আনসার আল ইসলামের নৈকট্য
আইএসপন্থী নব্য জেএমবির মতো পুরোনো জেএমবিও পরিচালিত হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। পুরোনো জেএমবির নেতৃত্ব মূলত সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিনের হাতে। ২০১৪ সালে প্রিজন ভ্যান থেকে জঙ্গিরা তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। গত কয়েক বছরে তাঁর নেতৃত্বে ভারতে জেএমবির সাংগঠনিক বিস্তার ঘটেছে বলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, পুরোনো জেএমবি সদস্যদের বড় অংশ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার। সালাহউদ্দিন সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করে উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক নতুন গ্রুপ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
একই সূত্র জানায়, সালাহউদ্দিন গত কয়েক বছরে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। মতাদর্শগত মিলের কারণে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে পুরোনো জেএমবির যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। আল-কায়েদা মতাদর্শী আনসার আল ইসলাম নিজেদের একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে থাকে। জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত সরকারি সংস্থার একটি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১১ জুন মুন্সিগঞ্জের প্রকাশক ও লেখক শাহজাহান বাচ্চু হত্যা জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের যৌথ হামলাও হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। দুই সংগঠনের ওয়েব পেজের ডিজাইনও একই রকম।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, কারাগারে জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আছেন। সেখানে উভয় সংগঠনের মধ্যে একটা যোগাযোগ, সমন্বয় গড়ে উঠেছে। এঁরা যৌথভাবে নাশকতায় নামলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
২০০৮ সালে জন্ম নেওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সালে ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। তবে গত পাঁচ বছরে সংগঠনটির দৃশ্যমান তৎপরতা বা কোনো নাশকতার খবর পাওয়া যায়নি। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, এ মুহূর্তে দেশের অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনায় আনসার আল ইসলাম সবচেয়ে সংগঠিত। এর সদস্যদের বেশির ভাগ শিক্ষিত এবং অনেকে প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। তারা ঘাপটি মেরে আছে। সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসিমুদ্দীন রাহমানী প্রায় সাত বছর ধরে কারাগারে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সংগঠনের অপারেশনাল কার্যক্রম চালাচ্ছেন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক, যিনি মেজর জিয়া নামে পরিচিত। তিনি আনসার আল ইসলামের কথিত সামরিক শাখার প্রধান। তাঁকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা গেছে, আনসার আল ইসলাম বিভিন্ন অ্যাপে গ্রুপ খুলে নিজস্ব যোগাযোগব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনেও সদস্য ও সমর্থক বৃদ্ধির চেষ্টায় আছে। এরা অনলাইনে উগ্রবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বেশি সক্রিয়।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে জঙ্গিবাদের বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর। বিশেষ করে যেসব বাংলাদেশি আইএসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়া বা আফগানিস্তানে গেছেন, তাঁরা দেশে নতুন করে কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করেন কি না, বা তাঁদের কেউ নব্য জেএমবির হাল ধরেন কি না; এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সিরিয়া ও ইরাক গেছেন, তাঁদের বড় অংশই মারা গেছেন বা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন বলে জানা গেছে। কতজন এখনো মুক্ত আছেন, তার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরেছেন। সম্প্রতি এমন একজন চট্টগ্রামে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তথ্য সংগ্রহ: প্রথম আলো