পেশায় চিকিৎসক তাহাউর ছোট থেকেই ছিলেন ভারত-বিদ্বেষী। পাকিস্তান ত্যাগের পর কিছু দিন অভিবাসন উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করেন তিনি। বিদেশে থাকাকালীনই ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবায় যোগ দেন রানা।
পাক বংশোদ্ভূত রানার রয়েছে কানাডার নাগরিকত্ব। বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলসের মেট্রোপলিটান ডিটেকশান সেন্টারে আটক রয়েছেন তিনি। পাক বংশোদ্ভূত আর এক সন্ত্রাসবাদী ডেভিড কোলম্যান হেডলির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। হেডলি আবার ছিলেন আমেরিকার নাগরিক।
বিদেশে বসে লস্করের হয়ে অর্থ সংগ্রহের কাজ করতেন তাহাউর। ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মেজর ইকবালের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, ২৬/১১-র মুম্বই হামলার মূল পরিকল্পনা ছিল রানার মস্তিষ্কপ্রসূত। হেডলির সঙ্গে মিলে গোট বিষয়টি ছকেছিলেন তিনি।
লস্কর ছাড়াও ইন্ডিয়ান মুজ়াহিদিন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাহাউরের। ভারতে নাশকতা ছড়িয়ে দিতে এই সংগঠনের সন্ত্রাসীদেরও কাজে লাগান তিনি। তদন্তকারীদের দাবি, হামলার আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই থেকে মুম্বই আসেন রানা। বাণিজ্যনগরীতে অন্তত ১০ দিন ছিলেন তিনি।
মুম্বই পুলিশ ও জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজ়েন্সি বা এনআইএ) নথি অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ১১ থেকে ২১ নভেম্বর মুম্বইয়ের হোটেল রেনেসাঁয় ছিলেন রানা। তিনি ভারত ছাড়ার পাঁচ দিনের মাথায় বাণিজ্যনগরীতে হামলা চালায় ১০ লস্কর জঙ্গি।
২০২৩ সালে আদালতে তাহাউর রানার নামে ৪০০ পাতার চার্জশিট জমা দেয় মুম্বই পুলিশ। ২৬/১১ মামলার এটি ছিল চতুর্থ চার্জশিট। সেখানে সন্ত্রাস হামলার পরিকল্পনায় কী ভাবে এই পাক জঙ্গি জড়িত ছিলেন, তা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন তদন্তকারীরা।
হামলার আগে মুম্বই শহর রেকি করেন হেডলি। ভারতে পর্যটন ভিসা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। জাল নথির সাহায্যে ওই ভিসা তাঁকে পাইয়ে দেন রানা। দু’জনের মধ্যে বেশ কয়েক বার ইমেল চালাচালিও হয়েছিল। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মেজর ইকবালও এই দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ইমেলকেই বেছে নিয়েছিলেন। চার্জশিটে এমনটাই দাবি করে মুম্বই পুলিশ।
এ ছাড়া হেডলি ও রানার কথোপকথনের একটি ভিডিয়ো পরবর্তী কালে হাতে পান তদন্তকারীরা। সেখানে তাহাউরকে মুম্বই হামলায় জড়িত জঙ্গিদের পাক সরকারের সর্বোচ্চ মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত করার দাবি জানাতে শোনা গিয়েছে। ২০০৯ সালে শিকাগোয় তাঁকে গ্রেফতার করে মার্কিন পুলিশ।
শিকাগোর ও’হেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রানার সঙ্গেই গ্রেফতার হন হেডলি। তাঁকে ৩৫ বছরের কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে আমেরিকার ফেডারেল আদালত। হেডলির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার তারিখটি ছিল ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। মুম্বই ছাড়াও ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে সন্ত্রাসবাদী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে পাক বংশোদ্ভূত এই মার্কিন নাগরিকের বিরুদ্ধে।
অন্য দিকে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে ওঠে রানার মামলা। সেখানে পাক বংশোদ্ভূত জঙ্গির সর্বশেষ আবেদনও খারিজ করে দেয় আদালত। এর পরই তাঁর প্রত্যর্পণের পথ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি রানার প্রত্যর্পণ নিয়ে মুখ খোলেন ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রী। তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।’’ ওই সময়েই তাহাউরকে ভারতে ফেরানোর ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন তিনি। এক সপ্তাহের মধ্যে এতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিল ওয়াশিংটন।
রানাকে প্রত্যর্পণের কথা ঘোষণা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘‘বিশ্বের অন্যতম শত্রু, যিনি ২০০৮ সালে মুম্বই হামলায় জড়িত, তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” এর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
সূত্রের খবর, রানাকে দেশে ফেরাতে কয়েক দিনের মধ্যে আমেরিকা যাবে এনআইএর একটি দল। পাক জঙ্গিটিকে নিয়ে কবে তাঁরা দেশে ফিরবেন, তা অবশ্য জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যেই গোটা প্রক্রিয়াটা শেষ করতে পারে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন।
২০০৮ সালের ১১ নভেম্বর মুম্বই শহরে হামলা চালায় ১০ লস্কর জঙ্গি। পাকিস্তানের করাচি থেকে সমুদ্রেপথে বাণিজ্য নগরীতে এসেছিল তারা। মাঝসমুদ্রে সোলাঙ্কি নামের এক মৎস্যজীবীর ট্রলার অপহরণ করে ওই ১০ সন্ত্রাসবাদী। ট্রলারে থাকা সবাইকে হত্যা করেছিল ওই জঙ্গিরা।
এর পর মুম্বই শহরে পৌঁছে আলাদা আলাদা কয়েকটি জায়গায় নির্বিচারে নিরীহ নাগরিকদের খুন করতে শুরু করে ১০ লস্কর সন্ত্রাসবাদী। তাজ হোটেল, ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস এবং কামা হাসপাতালে ঢুকে তাণ্ডব চালায় তারা। জঙ্গিদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে প্রাণ হারান মুম্বই পুলিশের সন্ত্রাস-বিরোধী শাখার তৎকালীন প্রধান হেমন্ত কারকারে। এ ছাড়া নিহত হন মুম্বই পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার অশোক কামতে এবং এনকাউন্টার স্পেশ্যালিস্ট ইনস্পেক্টর বিজ়য় সালসকার।
মুম্বই শহরকে জঙ্গিমুক্ত করতে শেষে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড বা এনএসজি কম্যান্ডোদের নামায় সরকার। তাজ হোটেলে ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’ শুরু করে তাঁরা। বাণিজ্য নগরীর ঐতিহ্যবাহী হোটেলটিতে প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে জঙ্গিদের সঙ্গে কম্যান্ডোদের চলে গুলির লড়াই। এই এনকাউন্টারে এক এক করে সন্ত্রাসীদের নিকেশ করে এনএসজি। গুলির লড়াইতে প্রাণ হারান মেজর সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণন।
এনএসজি অপারেশন শুরু করার আগেই অবশ্য আজ়মল আমির কাসভ নামের এক জঙ্গিকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলে মুম্বই পুলিশ। কিন্তু গ্রেফতারির সময় মুম্বই পুলিশের কনস্টেবল তুকারাম ওম্বলের বুক ২৩টি বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয় কাসভ। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।
পরবর্তী কালে কাসভের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় মুম্বই পুলিশ। বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর পুণের ইয়েরেওয়াড়া কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ওই চার্জশিটেও রানা এবং হেডলির নাম উল্লেখ করেছিল মুম্বই পুলিশ।
সুত্র: আনন্দ বাজার