প্রতীকী ছবি
দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত এক দশকে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বেড়েছে ১.৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে যৌন সহিংসতার হার ছিল ২৭.২ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮.৫ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সার্ভের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএসের অডিটরিয়ামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জরিপে চার ধরনের সহিংসতার তথ্য তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে শারীরিক সহিংসতা, যৌন, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারী তাঁদের জীবনসঙ্গী বা স্বামীর সহিংসতার শিকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৭.৪ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেন। বাকি ৯৩.৬ শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এ ছাড়া সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কারো সঙ্গে শেয়ার করেন না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে এতটাই প্রকট যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন।
৪১ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে গত ১২ মাসে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এসব পরিসংখ্যান জাতিসংঘের মানসম্পন্ন পরিমাপের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার বিস্তার পর্যবেক্ষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন সহিংসতামূলক আচরণ অন্তর্ভুক্ত করলে এই সহিংসতার ব্যাপকতা আরো বাড়ে।
বিবিএস জানিয়েছে, উত্তরদাতা নারীদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৪ শতাংশ) জীবদ্দশায় তাঁদের স্বামীর দ্বারা শারীরিক অথবা যৌন সহিংসতা বা উভয় সহিংসতার সম্মুখীন হলেও ১৬ শতাংশ নারী গত ১২ মাসে এ ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ এবং মানসিক সহিংসতা সর্বাধিক সংঘটিত সহিংসতার ধরন হিসেবে পাওয়া গেছে।
জরিপে জীবনসঙ্গী বলতে বর্তমান বা সাবেক স্বামী এবং ‘নন-পার্টনার’ বলতে বর্তমান বা সাবেক স্বামী ছাড়া উত্তরদাতার ১৫ বছর বয়সের পর থেকে জীবনের যেকোনো সময়ে সংস্পর্শে আসা যেকোনো ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, নারীদের অন্য কারো তুলনায় তাঁদের স্বামীর কাছ থেকে শারীরিক সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা তিন গুণ বেশি এবং যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা ১৪ গুণ বেশি। এতে প্রতীয়মান হয়, বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন সহিংসতার ঝুঁকি অত্যধিক বেশি।
জীবনসঙ্গী বা স্বামীর সহিংসতার মাত্রা বেশি হলেও সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ এসব কথা কাউকে কখনো বলেননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিবারের সুনাম রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং এ ধরনের সহিংসতা স্বাভাবিক বলে মনে করার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণ থেকে মূলত এই নীরবতা।
জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, এনডিসি এবং পরিসংখ্যান ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব আলেয়া আক্তার। ২০২৪ সালের নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক জরিপের মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম।
অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, মানসিকতার কারণে ভায়োলেন্স বাড়ে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো জায়গায়ও নারীর প্রতি সহিংসতা রয়েছে। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে মানসিক পরিবর্তন দরকার।
যৌন সহিংসতা সবচেয়ে বেশি শহরে। শহরে এই হার ৩১.৩ শতাংশ নারী। গ্রামে ২৮ শতাংশ নারী তাঁর জীবনে একবার হলেও যৌন সহিংসতার শিকার হন বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অন্যদিকে গত ১২ মাসে ৮.৯ শতাংশ নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি বরিশালে। জেলাটিতে সহিংসতার হার ৫০.৯ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ৩৩.৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫.৫ শতাংশ, ঢাকায় ৪৪.২ শতাংশ, খুলনায় ৫৭.২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪৩.৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৪৯.৯ শতাংশ এবং রংপুরে এই হার ৫০.২ শতাংশ।
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথার অজুহাতে নারী লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের শিকার : বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) আয়োজিত ‘নারী, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার’ শীর্ষক কর্মশালায় নারী নেত্রীরা বলেছেন, সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ২৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করেছে রাষ্ট্র। তবু নারীরা উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সম্পত্তিতে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথার অজুহাতে নারীরা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাবর রোডের বিএনপিএস সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত কর্মশালা সঞ্চালনা করেন বিএনপিএস পরিচালক শাহনাজ সুমী। বত্তৃদ্ধতা করেন গ্রাম বিকাশ সহায়তা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত মাসুদা ফারুক রত্না, পার্লামেন্ট নিউজ সম্পাদক সাকিলা পারভীন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লবির পরিচালক (লিগ্যাল) দিপ্তী শিকদার, বরিশালের আভাসের নির্বাহী পরিচালক রহিমা সুলতানা কাজল, রংপুরের সিড-এর নির্বাহী পরিচালক সারথী রানী সাহা, কক্সবাজারের অগ্রযাত্রার নির্বাহী পরিচালক মো. হেলাল উদ্দীন প্রমুখ।
কর্মশালায় বক্তারা বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো দেশের সব নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা, যা হবে দেশের উন্নয়ন ও ন্যায্যতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ