কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় এক নারীর উপর ঘটে যাওয়া পৈশাচিক নির্যাতন এবং সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া, সারাদেশের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। এটি কেবল একটি ঘটনার বিবরণ নয়, বরং আমাদের সমাজের অবক্ষয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং মানবতার চরম বিপর্যয়ের এক নগ্ন চিত্র। শনিবার রাতে যখন ৫১ সেকেন্ডের বিভৎস ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা কেবল ঘৃণা আর প্রতিবাদের ঝড় তোলেনি, বরং জন্ম দিয়েছে গভীর লজ্জা, ক্ষোভ আর অসংখ্য প্রশ্নের। ‘এই কিসের বাংলাদেশ?’ – এই প্রশ্ন আজ প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমরা একাত্তরের বিভীষিকা দেখিনি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা আমাদের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ২০২৪ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে যখন নিজের বোনকে এমন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে দেখি, তখন সেই লজ্জা কোথায় রাখি? এ লজ্জা কেবল মুরাদনগরের নয়, এ লজ্জা সমগ্র বাংলাদেশের, এ লজ্জা আমাদের সকলের। বিশেষ করে রাতের আঁধারে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনাগুলো সমাজে এক গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, যেখানে নারীরা দিনের আলোর পাশাপাশি রাতের নিরাপত্তাও হারাচ্ছেন।
আজ যেন ‘সোনার বাংলা’ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অথচ এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সুদের কারবারি, কিশোর গ্যাং এবং নারী নির্যাতনকারীদের দল। তাদের অপকর্মে বুক ফেটে যায়, কিন্তু সমাজের চোখ যেন নির্বাক দর্শকের মতো বন্ধ হয়ে আছে। এই নীরবতা, এই নির্বিকারত্বই অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে।
আমরা এই ঘটনায় স্তম্ভিত, আমরা লজ্জিত। এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। তবে এই বিচার কেবল আইনের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের দাবি ন্যায়বোধের চিৎকার থেকে উঠে আসা এক কঠোর বিচার।
প্রতিরোধে আমাদের করণীয়:
আইনের কঠোর প্রয়োগ: এমন জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব যেন বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: নারী নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি দূর করতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল – সব জায়গায় নারীর প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। রাতের বেলায় নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটির মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে রাত্রিকালীন টহল বাড়ানো, এলাকার চিহ্নিত সমস্যাপ্রবণ স্থানগুলোতে নজরদারি বৃদ্ধি করা এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
মানসিকতার পরিবর্তন: পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গভীরে প্রোথিত নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা অপরিহার্য। নারীর প্রতি সহিংসতা যে কোনো সভ্য সমাজে অগ্রহণযোগ্য, এই বার্তা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো: নির্যাতিতাদের প্রতি সমাজের সহানুভূতি ও সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। তাদের আইনি ও মানসিক সহায়তা প্রদান করে সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা সাহসের সাথে জীবনLয়ে দাঁড়াতে পারেন।
তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ঘটনার ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা একদিকে যেমন জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে, তেমনি নির্যাতিতাদের জন্য আরও যন্ত্রণা বয়ে আনছে। এসব ভিডিও প্রকাশ ও প্রচার বন্ধে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং এর অপব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে, প্রশাসনকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব ও আমাদের অঙ্গীকার:
কুমিল্লার এই ঘটনা বাংলাদেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। আন্তর্জাতিক মহলেও নারী নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। আমরা যদি এখনই রুখে না দাঁড়াই, তাহলে কালকের শিকার হতে পারে আরেক মা, আরেক বোন, আমাদেরই আরেক কন্যা। আমরা আর কোনো মাকে কাঁদতে দেখতে চাই না, কোনো বোনকে লাঞ্ছিত হতে দেখতে চাই না। এই অমানবিকতার পুনরাবৃত্তি রোধে এখনই রুখে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের অঙ্গীকার হোক – নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত এক সুরক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার, যেখানে প্রতিটি নারী নির্ভয়ে, সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে, দিনের আলোয় এবং রাতের আঁধারেও।
Dilara jahan
কুমিল্লায় নারীর উপর পৈশাচিক নির্যাতন: মানবতা কি আজ বিপন্ন?
previous post
