বর্তমানে খবরের কাগজ থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলেই আমরা নারীর প্রতি কোনো না কোনো সহিংসতার খবর দেখতে পাই। এ যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত বছর জুলাইয়ের পর হরহামেশা আসামিকে গ্রেপ্তার করার খবরও দেখা যায়, কিন্তু বিচারকার্য শেষ করে শাস্তি হয় কয়জনের, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আসলেই কি সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে?
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’ অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ নারী অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদিকে ২০২৪ সালে ৪৯ শতাংশ নারীর ওপর এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত গত কয়েক দিনের সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিশু, গর্ভবতী নারী, বিশেষভাবে সক্ষম নারী, কেউই যৌন নির্যাতন ও সহিংসতা থেকে রেহাই পাননি। মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে একজন শিশু (৬ মার্চ), কুমিল্লায় প্রতিবন্ধী তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে (৬ মার্চ), মুন্সীগঞ্জে খাবার ও বেলুনের লোভ দেখিয়ে দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ গ্রেপ্তার হয়েছেন (৮ মার্চ), টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দেড় লাখ টাকায় শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে (৮ মার্চ), গাজীপুরে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ভিডিওধারণ করা হয়েছে (৯ মার্চ), নরসিংদীতে তিন দিন আটকে রেখে গর্ভবতী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে (৯ মার্চ), চট্টগ্রামে ১০ বছর বয়সি মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা গ্রেপ্তার হয়েছেন (১০ মার্চ), জামালপুরে গান শোনানোর কথা বলে পাঁচ বছর বয়সীসি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে (১১ মার্চ)। এ ছাড়া জনপরিসরে ধূমপান করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে (১ মার্চ)। খুঁজে দেখলে আরও অনেক সহিংসতার ঘটনা পাওয়া যাবে যেগুলোর খবর নিয়ে তেমন শোরগোল হয়নি অথবা ভুক্তভোগী অভিযোগই করেননি।
কেন বাড়ছে সহিংসতা
সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনের কারণ খুঁজলে পাওয়া যায় বহুমাত্রিক কারণ। বিচারহীনতা ও বিচারে দেরি এর মধ্যে অন্যতম। দেশের বেশিরভাগ নারী নির্যাতন মামলার ন্যায়বিচার বা শাস্তি কার্যকর দুর্লভ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, বিগত ১৯ বছরে বাংলাদেশে ৯৯ শতাংশ ধর্ষণ মামলার আসামি কোনো দণ্ডের আওতায় আসেনি। এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের থেকে জানা যায়, পুলিশ স্টেশনে গেলে কর্মকর্তারা ‘পারিবারিক আপস’ করতে পরামর্শ দেন, আদালতে মামলা চলে বছরের পর বছর আর শাস্তি হলেও তা বাস্তবায়ন হয় কমই। ফলে অপরাধীরা ধরেই নেয় যে, শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম, যা সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
এ ছাড়া প্রায়ই দেখা যায় এই অপরাধীরা এলাকায় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন। এরা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে বিচার প্রক্রিয়া রুদ্ধ করেন এবং ভুক্তভোগীকে প্রাণনাশ থেকে শুরু করে, বাস্ত্যচুতের মতো নানা ঝুঁকি ও হুমকির মাঝে রাখেন। উদাহরণস্বরূপ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধূ ও তার ১২ বছর বয়সি মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাসহ নয়জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এক বছর পরে এসে এখনও রায় কার্যকরের কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি, বরং প্রধান আসামি আবুল খায়ের মুন্সি গত নভেম্বরে জামিন পেয়ে ভুক্তভোগীদের নানাভাবে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। যদিও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত দল, বর্তমানে তবু অপরাধীর এই ক্ষমতা প্রদর্শন এটাই প্রমাণ করে যে প্রভাব, অর্থবিত্তর কাছে ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচার ও শাস্তি কার্যকরের দাবি চাওয়া কতটা নগণ্য।
যারা সাধারণত এই সহিংসতাগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকে, সেসব অপরাধীকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণ সাধারণত যৌন তৃপ্তির জন্য নয়, বরং ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শনের প্রবৃত্তি থেকে করে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের কোনো না কোনো ধাপে নারীরা পুরুষ দ্বারা অহেতুক ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে সহিংসতার শিকার হন। একজন অপরাধীর মনস্তত্ত্বর গভীরে কাজ করে নারীকে অধস্তন বিবেচনা করার প্রবণতা। অপরাধীরা নিজেকে শক্তিশালী মনে করেন এবং এতে আশকারা দেয় দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া ও পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা। তারা প্রায়ই নিজের অপরাধকে খতিয়ে দেখার বদলে নারীর ভুল খুঁজে বের করে এবং ভুক্তভোগীকেই দায়ী করে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সমাজে যতটা না যুক্তি দেওয়া হয় ভিকটিম ব্লেমিং-এ তার খুব কম অংশই অপরাধীকে দোষারোপ করার পেছনে দেখানো হয়। সমাজের পক্ষপাতমূলক ব্যবহার নারীর প্রতি সহিংসতাকে যুগ যুগ ধরে স্বাভাবিক করে ফেলেছে। আবার অনেকেই নির্যাতনের মিথ্যা মামলার উদাহরণ দেখিয়ে অনেক সহিংসতাকে জাস্টিফাই বা ন্যায্যতা প্রতিপাদন বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এই মিথ্যা নির্যাতন মামলার সংখ্যা বর্তমানে ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি সহিংসতার সত্য মামলার তুলনায় অতিনগণ্য।
পাশাপাশি পরিবার হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায় অনুশীলনের প্রধান ও প্রথম মাধ্যম বা মিডিয়াম। দেশের অনেক পরিবারের উভয় ছেলে ও মেয়েসন্তান তাদের মা বা নারী সদস্যদের পুরুষ সদস্য দ্বারা মারধর, মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে দেখে আসে, তারা আগ্রাসনকে সম্পর্কের স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গ্রহণ করে। এই অনুশীলন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসতে থাকে।
বাংলাদেশে কাগজে-কলমে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতামুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া কঠিন। দিন আসছে এবং মামলার সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যান সহিংসতার বিস্তৃতি প্রমাণ করে, তবে অপরাধ মনোবিজ্ঞান উন্মোচন করে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য যেখানে নারী সমাজের সময়ের সঙ্গে বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়াকে আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করা হয়।
প্রয়োজন যেমন দ্রুত বিচার ও শাস্তি কার্যকর ব্যবস্থার, তেমনি সামাজিক শিক্ষা, সচেতনতার প্রসার অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধু নারীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে সহিংসতা কমানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার মাঝেই নারীর প্রতি সহিংসতাকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সময়ের দাবি। ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রবণতাকে নির্মূল করতে হলে শুধু হটলাইন, পুনর্বাসনের চেয়েও বেশি কিছু দরকার; যা হবে দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ। সমাজে নারীর অবস্থানকে সম্মানীয়, নিরাপদ করতে হলে ছেলেবেলা থেকেই গেঁথে দেওয়া আধিপত্যের মিথ ভেঙে ফেলা এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো যৌক্তিকভাবে পরিবর্তন করা, যেগুলো বেশিরভাগ সময়ই ধর্ম ও পরম্পরা প্রথার দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রভাব যে কতটা ভয়ানক, তা নিজ পরিবারের সদস্য বা নিজের সঙ্গে হওয়ার আগে অনেকেই উপলব্ধি করেন না।
সহিংসতার শিকার নারীদের মানসিক অবস্থা
যে নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাদের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই বেশ নাজুক থাকে। সামাজিকভাবে হীনতার শিকার হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। যারা নতুন করে বাঁচতে শেখেন, তাদের পাড়ি দিতে হয় অনেক কঠিন পথ। তাদের মানসিক অবস্থা কতটা কঠিন হয়, এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয় যেন তারাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অথচ আমরা বুঝতে চাই না তাদের মানসিক অবস্থা কতটা দুর্বল।
নারী সহিংসতায় মানসিক সাপোর্ট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ‘শোনো’। মেন্টাল হেলথ সার্ভিস নিয়ে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। শোনোর কো-ফাউন্ডার ও সিইও মেরিলিন আহমেদ বলেন, নারী সহিংসতার শিকার কেউ যখন আমাদের কাছে আসেন, আমাদের সাইকোলজিস্টরা প্রথমেই তার নিরাপত্তা ও আস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। সহিংসতা, একজন নারীর আত্মমর্যাদা, নিরাপত্তাবোধ ও মানসিক ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলে। তাই ধাপে ধাপে তার অনুভূতি প্রকাশে সহায়তা করা, ট্রমা অ্যান্ড ভায়োলেন্স-ইনফর্মড কেয়ার মডেল অনুসরণ করা এবং তার নিজস্ব ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধারে উৎসাহ দেওয়া হয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য যথেষ্ট সময়, সহানুভূতি ও পেশাগত গাইডেন্সের প্রয়োজন হয়। তাই সহিসংসতার শিকার নারী ও তার পরিবার থেকে কেউ যদি এসে থাকে, তাদেরকেও অনেক সময় কাউন্সেলিংয়ের আওতায় এনে একজন নারীকে ধীরে ধীরে নিজের ক্ষত সারিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীদের নানাবিধ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা হিসেবেও দেখা দেয়। তখন সেইগুলোর জন্য আলাদা যত্ন ও কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হতে পারে।
আমাদের সবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে প্রত্যেক নারী ও শিশু নির্ভয়ে বাঁচতে পারবে। শুরুটা হোক নিজ থেকেই। নতুবা দিন দিন সহিংসতার পরিসংখ্যানই বাড়বে, শুধু নিরাপত্তা নয়।
সুত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ