ফাহমিদা তাহসিন কেয়া ছিলেন মাত্র পঁচিশ বছরের এক তরুণী। বয়সটা ছিল স্বপ্ন দেখার, নতুন কিছু শুরু করার, পড়াশোনা বা নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার। কিন্তু সেই বয়সেই তাকে চার সন্তানের মা হতে হলো। ছোট্ট জীবনে সংসারের ভার কাঁধে নিতে গিয়ে নিজের ইচ্ছা, স্বপ্ন সবকিছু যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন কেয়া। অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয়েছিল। এখানে বাবা-মায়েরও দায় কম নয়। সমাজের কথায়, “মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে”, “লজ্জার বিষয়”, “ভালো প্রস্তাব পেলে হাতছাড়া করা যাবে না”—এসব চিন্তা থেকে বাবা-মা তাকে খুব দ্রুত বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। অথচ, কেয়া তখনও ঠিকভাবে বুঝতেই পারেননি সংসার নামের দায় কতটা গভীর, কতটা ভারী। শুরুতে বাইরে থেকে সব স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাচ্ছিল কেয়া। স্বামী তার ওপর মানসিক চাপ দিতেন, কথা বলার সময় কড়া ও রূঢ় আচরণ করতেন। ছোটখাটো তর্ক, ধমকি, অসম্মান—সবই যেন কেয়ার হাসি কেড়ে নিল। যে মেয়েটি একসময় প্রাণবন্ত, হাসিখুশি ছিল, সে ধীরে ধীরে হয়ে উঠল নিরব, নিস্তব্ধ। কেউ খেয়াল করেনি, কেয়ার ভেতরে কতটা ঝড় বইছিল। সন্তানদের কথা ভেবে তিনি মুখ বন্ধ রাখতেন, কিন্তু চোখের পানি লুকানো যেত না। আসলে শুধু স্বামী নয়—সমাজও দায়ী। সমাজ এখনো নারীকে অধিকার দেয়নি তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার, নিজের মতো করে জীবন গড়ার। নারীরা আজও নির্যাতিত, অবহেলিত—কখনো শারীরিকভাবে, কখনো মানসিকভাবে। কেয়ার গল্প তার করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল। একদিন হঠাৎ খবর এলো—কেয়া গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ঘোষণা দিলেন, কেয়া আর নেই। চারটি সন্তানকে ফেলে এক তরুণী মা চিরতরে হারিয়ে গেলেন। মায়ের আহাজারিতে শোনা গেল,
“আমার মেয়েটা সংসারে ভালোবাসা দিয়ে গেল, দায়িত্ব পালন করে গেল, তবুও তার জন্য সুখ ছিল না। ওর যন্ত্রণা কেউ বোঝেনি। এই গল্প শুধু একটি পরিবারের নয়—এটি আমাদের চারপাশের হাজারো মেয়ের গল্প। বাবা-মা যদি একটু ভেবে, সময় দিয়ে, মেয়েকে পড়াশোনার সুযোগ দিতেন, নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখতে দিতেন, হয়তো আজকের এই পরিণতি হতো না। আর সমাজ যদি নারীদের অধিকারকে সম্মান করত, সংসারে যদি সমান মর্যাদা ও সহমর্মিতা থাকত, তবে হয়তো কেয়া আজও বেঁচে থাকত। কেয়া নেই, কিন্তু তার জীবন আমাদের শেখায়, অল্প বয়সে বিয়ে কোনো সমাধান নয়, বরং অনেক নারীর জন্য হয়ে দাঁড়ায় জীবনভর দুঃখের কারণ।
সংসারে বোঝাপড়া, ভালোবাসা আর সম্মান ছাড়া পরিবার টেকে না।
নারীকে নিজের মতো করে বাঁচতে দিলে, তার অধিকারকে স্বীকৃতি দিলে, সমাজ এগোয়—না হলে ধ্বংস হয়। কেয়ার গল্প তাই আমাদের চোখ খুলে দেয়—ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর নারীর অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া একটি পরিবার বা সমাজ কখনোই শান্তি পেতে পারে না।
