আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই মেয়ে শিশুকে শেখানো হয়–‘তুমি মেয়ে, তাই এটি করতে পারো না’, ‘তোমার উচিত বাইরে কম যাওয়া’, ‘তুমি সবসময় নরম, ভদ্র আর চুপচাপ থাকবে’। এই লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক প্রশিক্ষণ ধীরে ধীরে মেয়েশিশুর মনে এক ধরনের ভয়, আত্মদ্বন্দ্ব আর হীনম্মন্যতা গেঁথে দেয়। তারা বুঝে ওঠার আগেই নিজের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয়ে পড়ে, আত্মবিশ্বাস হারায়। জীবনের প্রতিটি ধাপে নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো দেখতে থাকে। তখন তাদের মনে জন্ম নেয় অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতাবোধ। এ কারণে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শৈশবেই যদি শিশুকে সমান মর্যাদা ও স্বাধীনতা না দেওয়া হয়, তবে বড় হয়ে সে আত্মসম্মানবোধের সংকটে পড়ে। ফলে অনেক নারী জীবনের নানা পর্যায়ে সম্পর্ক, কাজ বা সমাজে নিজের অবস্থান নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে থাকেন। আবার এর সঙ্গে যুক্ত করুন বাল্যবিয়ের বাস্তবতা। গত মার্চে ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীর মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে।
নীলাদের বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার এক গ্রামে। তাঁর বাবা দারিদ্র্যের কারণে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন এক ২৮ বছর বয়সী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। ১৩ বছরের নীলার মত কেউ জানতে চায়নি। শারীরিক ও মানসিকভাবে তখনও তিনি কৈশোরে; কিন্তু বিয়ের পরপরই তাঁর ওপর গৃহস্থালি দায়িত্ব, শ্বশুরের দেখাশোনা, যৌন সম্পর্ক এবং কিছুদিন পর থেকে সন্তান জন্মদানের চাপ শুরু হয়। এখন নীলার বয়স ১৯। তিনি জানান, প্রথম দিকে প্রায়ই কাঁদতেন, স্কুলের সহপাঠীদের কথা মনে করে হতাশ হয়ে যেতেন। দিনে বা রাতে নীলার কথা শোনার কেউ নেই। নীলা নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করেন। স্বামী ও তাঁর পরিবারের কাছে নীলা অনেকটা সেই পুতুলের মতো–যে আদেশ মানতে বাধ্য, তাঁর নিজের কোনো কথা থাকবে না। ১৫ বছর বয়সে সন্তান জন্মের সময় জটিল প্রসবের কারণে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। ধীরে ধীরে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দেয়– আত্মগ্লানি, না হাসা, কথা না বলা, সন্তানকে কোলে নিতে অনীহা–এমনকি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা। পাশাপাশি দুঃস্বপ্ন দেখা, আচমকা আতঙ্কে কেঁপে ওঠা–এগুলো পরে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) লক্ষণ বলে শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। কোলের সন্তানকে রেখে নীলাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
রেশমা বিয়ের পর বিলাসবহুল জীবনে প্রবেশ করেন। স্বামী প্রায়ই বিদেশে থাকেন, ঘনিষ্ঠতা কম এবং সম্পর্কটি নিছক সামাজিক প্রদর্শনীতে পরিণত হয়। তিনি নিজেকে সবসময় একা ও অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন। ধীরে ধীরে বিষণ্নতা, নিদ্রাহীনতা ও স্থিরতা দেখা দেয়। সাইকোথেরাপি নিয়ে তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত না হওয়ায় তারা পারস্পরিক সম্মতিতে আলাদা হয়ে যান। রেশমা এখন পৈতৃক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। জীবনকে নতুন চোখে দেখছেন।
চার বছর প্রেমের সম্পর্ক যখন পরিণয়ে পৌঁছায়, সামিয়া ভেবেছিলেন স্বামীর সঙ্গে সুখের আসর গড়বেন। নিজে চাকরি না করে স্বামী-সংসারেই পুরো সময়টা দিতে চেয়েছিলেন। দাম্পত্য সম্পর্ক প্রেমের সম্পর্কের চেয়ে ভিন্ন। শুরু থেকেই মতবিরোধ, ছোটখাটো বিষয়ে তর্ক এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস দাম্পত্য জীবনে স্থায়ী হয়ে ওঠে। স্বামী সবসময় তাঁকে খাটো করতেন এবং প্রায়ই ধমক দিয়ে কথা বলতেন। ধীরে ধীরে সামিয়া নিজেকে অক্ষম ও একাকী মনে করতে শুরু করেন। তাঁর মধ্যে হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের সমস্যা, কাজের প্রতি অনাগ্রহ এবং হঠাৎ হঠাৎ কান্না চলে আসা–সবই ছিল মানসিক সমস্যার লক্ষণ। এক বান্ধবীর পরামর্শে সামিয়া মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান। চিকিৎসক তাঁকে নিয়মিত কাউন্সেলিং, কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (সিবিটি) এবং প্রাথমিক পর্যায়ের অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ দেন। একই সঙ্গে তিনি দাম্পত্য পরামর্শের (কাপল থেরাপি) জন্যও বলেন, তবে স্বামী এতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। কয়েক মাস পর সামিয়া নিজেই সিদ্ধান্ত নেন আলাদা থাকার। বর্তমানে তিনি বিবাহিত নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
এর বিপরীতে সহানুভূতিশীল সঙ্গী ও পরিবারও যে একেবারে নেই, তা নয়।
মেহজাবিনের বয়স ৩৫ বছর। দুই সন্তানের জননী। প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ ঘণ্টা অফিস করতেন। অফিসের চাপ, ঘরের গৃহস্থালি কাজ, সন্তানের যত্ন–সবকিছু সামলাতে গিয়ে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সময়ই পেতেন না। বেশ কয়েক মাস ধরে তাঁর মধ্যে ক্লান্তি, বিরক্তি, অনিদ্রা, কাজের প্রতি আগ্রহহীনতা ও আত্মমূল্যায়নের ঘাটতি দেখা দেয়। সহকর্মীরা লক্ষ্য করেন, একসময় প্রাণবন্ত এই নারী এখন নিস্তেজ ও বিষণ্ন।
একজন সহকর্মীর পরামর্শে তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক জানান, তিনি দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ ও ক্লান্তি থেকে সৃষ্ট বিষণ্নতা ও ‘বার্নআউট সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত।
মেহজাবিনকে নিয়মিত কাউন্সেলিং, মেডিটেশন এবং কাজের সময়সূচি পুনর্বিন্যাসের পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁর স্বামী ও পরিবার গৃহস্থালি কাজে সাহায্য করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে ফিরে পান এবং বুঝতে শেখেন মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা কোনো বিলাসিতা নয়; বরং টিকে থাকার শর্ত।
সুত্রঃ সমকাল