ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে ফের সমালোচনা তীব্রতর হয়েছে। জেফরি অ্যাপস্টিনের কেলেঙ্কারির অন্যতম ভুক্তভোগী কিশোরী ভার্জিনিয়া জিউফ্রের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তার স্মৃতিকথা ‘নোবডিস গার্ল’। ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে অ্যাপস্টিন, ঘিসলেইন ম্যাক্সওয়েল এবং তাদের প্রভাবশালী বন্ধুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
জিউফ্রে বইটিতে লিখেছেন, তখনকার ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সঙ্গে তাকে তিনবার ‘যৌন সম্পর্কে মিলিত হতে বাধ্য’ করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেছেন, ২০০১ সালের মার্চ মাসে লন্ডনে ঘিসলেইন ম্যাক্সওয়েলের বাড়িতে থাকার সময় প্রথমবার এমন যৌনতার শিকার হন তিনি। ম্যাক্সওয়েল প্রিন্সকে বলেন, জিউফ্রের বয়স অনুমান করতে-যার উত্তরে প্রিন্স অ্যান্ড্রু বলেন, ‘১৭’। তখন প্রিন্সের বয়স ছিল ৪১।
সেই রাতেই তোলা হয় সেই বিখ্যাত ছবিটি-যেখানে প্রিন্স অ্যান্ড্রু কিশোরী জিউফ্রের কোমরে হাত রেখেছেন। আর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন এই যৌন ব্যবসার হোতা ঘিসলেইন ম্যাক্সওয়েল। খবর বিজনেস ইনসাইডারের।
জিউফ্রে লিখেছেন, ‘ডিনারের পর ও লন্ডনের ট্র্যাম্প নাইটক্লাব থেকে ফেরার পর তিনি তাড়াহুড়ো করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন। সবকিছু মিলিয়ে আধঘণ্টারও কম সময় লেগেছিল।’
প্রিন্স অ্যান্ড্রুর আইনজীবীরা বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও, প্রিন্স এর আগে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বইটির সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়গুলোর একটি হলো প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের বর্ণনা। জিউফ্রে লিখেছেন, অ্যাপস্টিনের নিজস্ব ভার্জিন দ্বীপে এক ‘অর্গি’ পার্টিতে তিনি, অ্যাপস্টিন, প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং আরও প্রায় আটজন তরুণী উপস্থিত ছিলেন। কিছুদিন পর তিনি অনিয়মিত রক্তক্ষরণে ভুগতে শুরু করেন এবং একদিন অ্যাপস্টিনের ম্যানহাটনের প্রাসাদে ‘রক্তের পুলে’ জেগে ওঠেন।
‘আমি কয়েক দিন হাসপাতালে ছিলাম,’ লিখেছেন তিনি। ‘চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতেন অ্যাপস্টিনই। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি গর্ভপাত করেছি। কিন্তু আমার মেডিকেল রিপোর্টে সে শব্দটি কোথাও লেখা ছিল না।’
জিউফ্রের ধারণা, হয়তো তার জরায়ুর বাইরে কোথাও ভ্রূণটি বেড়ে উঠেছিল (একটোপিক প্রেগন্যান্সি), যার জন্য অস্ত্রোপচারে পেট কাটা হয়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম, আমি গর্ভবতী হয়েছিলাম এবং ভ্রূণ হারিয়েছি-এমনকি না জেনেই। কিন্তু শোক সইবার মতো সময়ও ছিল না, কারণ অ্যাপস্টিন ও ম্যাক্সওয়েলের জগতে পার্টি কখনও থামত না।’
২০১১ সালে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর কারণে প্রকাশ্যে আসার সিদ্ধান্ত নেন জিউফ্রে। সে সময় তিনি স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যখন দেখেন, যৌন অপরাধে দণ্ডিত অ্যাপস্টিন আবারও নামীদামী ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন, তখনই তিনি এগিয়ে আসেন।
‘লন্ডনে ২০০১ সালে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সঙ্গে প্রথম যৌন সম্পর্কের সময় অ্যাপস্টিনের এই প্রবণতা লুকানো থাকত। কিন্তু ২০১১-তে সবাই জানত, সে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত যৌন অপরাধী,’ লিখেছেন জিউফ্রে। ‘তবু তাকে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর পাশে দেখে আমার মনে হয়েছিল, “র্যান্ডি অ্যান্ডি” আরও উদ্ধত হয়ে উঠেছেন।’
২০১৯ সালে কারাগারে থাকাকালীন আত্মহত্যা করেন জেফ্রি অ্যাপস্টিন। ২০২১ সালে জিউফ্রে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা করেন, যা ২০২২ সালে আদালতের বাইরে মীমাংসিত হয়।
প্রিন্স অ্যান্ড্রু এক বিবৃতিতে স্বীকার করেন, ‘জিউফ্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং জনসমালোচনার মুখেও পড়েছেন।’ যদিও এতে কোনো অপরাধ স্বীকারোক্তি ছিল না, জিউফ্রে তবু এটিকে নিজের জয় হিসেবে দেখেছিলেন।
তিনি লিখেছেন, ‘আমরা জানতাম স্বীকারোক্তি পাব না-সেটাই তো মীমাংসার উদ্দেশ্য। কিন্তু অন্তত কিছুটা স্বীকৃতি চেয়েছিলাম।’
চুক্তি অনুযায়ী, জিউফ্রেকে এক বছরের জন্য প্রিন্স অ্যান্ড্রু সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য না করার শর্তে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়েছিল।
‘আমি এক বছরের “গ্যাগ অর্ডার”-এ রাজি হয়েছিলাম,’ লিখেছেন তিনি। ‘এটি প্রিন্সের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এতে তার মায়ের “প্লাটিনাম জুবিলি” উদ্যাপন আরও কলঙ্কিত হতো না।’
বইটির প্রকাশের মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রিন্স অ্যান্ড্রু তার বাকি সব রাজকীয় উপাধি ত্যাগ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নিজের বিরুদ্ধে চলমান অভিযোগগুলো রাজপরিবারের দায়িত্ব পালনে ‘বাধা সৃষ্টি করছে’।
ভার্জিনিয়া জিউফ্রে চলতি বছরের এপ্রিলে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তার এই স্মৃতিকথা ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ রাজপরিবারের জন্য এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সুত্রঃ চ্যানেল২৪.কম
