২০২৫ সাল। বছরজুড়েই সহিংসতা, হেনস্তা আর নির্যাতনের ভার বইতে হয়েছে বাংলাদেশের নারীদের। বিভিন্ন পরিসংখ্যান, সংবাদ শিরোনাম ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় তা স্পষ্ট। বছরজুড়ে ঘরে ও বাইরে, বাস্তব ও ভার্চুয়াল- সবখানেই নারীরা নানাভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। কখনও পোশাক নিয়ে প্রশ্ন, কখনও চলাফেরা নিয়ে কটাক্ষ, কখনও স্বাধীন মত প্রকাশের শাস্তি হিসেবে হেনস্তা। নারীর শরীর, সিদ্ধান্ত ও স্বপ্ন- সবকিছুর ওপরই যেন নজরদারি ছিল অব্যাহত। বছরজুড়ে নারীদের ওপর নির্যাতন এবং সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছেন রিয়ানা ইসলাম রিম্পা
২০২৫ সালে আলোচিত নারী সহিংসতাবিষয়ক প্রতিবেদনগুলোর কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’। এই জরিপ প্রকাশের পর বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে ভয়াবহ একটি তথ্য- দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার শারীরিক, মানসিক, যৌন বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এই সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়; এটি ২০২৫ সালের প্রতিটি সংবাদের পেছনের নীরব বাস্তবতা।
ঘরের ভেতরের সহিংসতা
২০২৫ সালে পারিবারিক সহিংসতা ছিল নারীর প্রতি নির্যাতনের সবচেয়ে বড় দিক। পত্রিকার পাতায় বারবার উঠে এসেছে- যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামীর হাতে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, শ্বশুরবাড়িতে অবমাননা, এমনকি হত্যার ঘটনা।
আইন থাকলেও বিচারহীনতা বড় বাধা। মামলা করতে গেলে সামাজিক কলঙ্ক, পারিবারিক চাপ আর দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার ভয় নারীদের পিছু টানে। অনেকেই শেষ পর্যন্ত আপস করতে বাধ্য হন- সহিংসতা যেন ‘নারীর ভাগ্য’ হিসেবেই থেকে যায়। ১৩ আগস্ট মধ্যরাতে ফাহমিদার মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, ফাহমিদাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন স্বামী সিফাত। পরে তিনি ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাও করেন। অন্য খবরে জানা যায়, গত ১৮ জুন সিলেটের গোলাপগঞ্জে স্ত্রীকে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। এপ্রিলে পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী, সন্তান ও স্ত্রীর বড় বোনকে হত্যা করে লাশ তিনটি বস্তাবন্দি করে মাটিচাপার ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে।
একটি-দুটি নয়, পারিবারিক সহিংসতার এমন ঘটনা রোজ ঘটছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে যেসব অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়, সেই তালিকায় নারী ও শিশু নিপীড়ন সবার ওপরে।
‘চট্টগ্রামে মসলা বাটার নোড়া (শিল) দিয়ে আঘাত করে গৃহবধূকে হত্যা’, ‘সিলেটে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে পেট্রোল ঢেলে আগুন’, ‘স্ত্রীকে হত্যা করে লাশে আগুন’, ‘স্ত্রীকে হত্যা করে থানায় স্বামী’- এমন সব বর্বরতার অসংখ্য খবর যেগুলো নারীদের ট্রমাগ্রস্ত করে ফেলতে পারে। এ ছাড়াও শিশু ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, ‘একটি মেয়ে যখন বিয়ের মাধ্যমে নতুন কোনো পরিবারে যায়, তখন তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন চায়, তাদের প্রতিটি কথা মেয়েটি মেনে নেবে। এ ধরনের পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্যাতনের ক্ষেত্র তৈরি করে। যে নারীর পড়াশোনা কম, পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল, তারা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সমাজে এক ধরনের ট্যাবু আছে। ফলে মেয়েদের পরিবার চায়, যেভাবেই হোক মেয়ে যেন সংসার টিকিয়ে রাখে। এই মনোভাব থেকে নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বল অবস্থার কারণেও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা প্রভাবশালী মহলের আশ্রয় ও প্রশ্রয় পায়, ফলে বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়াটাও জরুরি। শাস্তির ভয় থাকলে নির্যাতন কম হয়। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
সহিংসতার শিকার প্রতিবন্ধী নারী
২০২৫ সালের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় প্রতিবন্ধী নারীদের পরিস্থিতি। জরিপে উঠে আসে, প্রতিবন্ধী নারীরা অন্য নারীদের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি সহিংসতার ঝুঁকিতে। এই তথ্য প্রকাশের পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা, যৌন নির্যাতন ও অবহেলার ঘটনা উঠে আসে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়- প্রতিবন্ধকতাকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে ব্যবহার করে নির্যাতনকারী সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। সমাজ ও বিচারব্যবস্থার নীরবতাই তাদের সহিংসতাকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে।
কর্মক্ষেত্র ও পরিবহনে হয়রানি
২০২৫ সালে অফিসে যৌন নিপীড়ন এবং গণপরিবহনে হেনস্তার ঘটনাও কম ছিল না। বাস, ট্রেন, রাইড শেয়ারিং- সবখানেই নারীরা অনিরাপদ। খিলগাঁও এলাকায় অটোরিকশায় চালক দ্বারা নারী হেনস্তা। ওড়না পরা নিয়ে শ্যামলীতে নারী হেনস্তা। অফিসে অভিযোগ করলে চাকরি হারানোর ভয়, পদোন্নতিতে বাধা- এসব কারণে অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে গেছে। যদিও আদালতের নির্দেশনায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই তা কার্যকর নয়- এই বাস্তবতা সংবাদে উঠে এসেছে বারবার। বছরের আলোচিত ঘটনা ছিল গণমাধ্যমে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার যৌন নিপীড়নের শিকার গণমাধ্যমকর্মীর আত্মহত্যা।
শিশু ধর্ষণের ঘটনা
২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যে। আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ৩০৬ মেয়েশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে ছিল ১৭৫। এই সংখ্যা ইতোমধ্যে গত পুরো বছরে রিপোর্ট হওয়া মোট ২৩৪টি ঘটনার তুলনায়ও অনেক বেশি।
ভুক্তভোগীদের বয়সের পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। তাদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছরের মধ্যে, ৯৪ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে এবং ১০৩ জন কিশোরী। ৬০টি ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স উল্লেখ করা হয়নি।
এ বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, মার্চে ১০৬টি এবং এপ্রিলে ৬৪টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৯ ও ২৪।
১৬ দিনব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ
২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর- ‘১৬ দিনব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ২০২৫’ পালিত হয় দেশজুড়ে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো সচেতনতামূলক সেমিনার, টিভিসি, মানববন্ধন ও ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে। এই সময় বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় ট্রমা সেন্টার ও হটলাইন ১০৯। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, সচেতনতা বাড়ায় অনেক নারী প্রথমবারের মতো সাহায্য চাইতে এগিয়ে আসেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এই উদ্যোগগুলো বছরজুড়ে ধারাবাহিক না হলে কাংক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।
গভীর কাঠামোগত সংকট
২০২৫ সালের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে- নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক ও কাঠামোগত সংকট। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, লিঙ্গবৈষম্য, যৌতুক প্রথা, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও নিম্ন সাজার হার- সব মিলেই সহিংসতাকে টিকিয়ে রাখছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা সতর্ক করেছে- নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ না হলে ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব নয়। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- সব ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ডিজিটাল পরিসর : নতুন যুদ্ধক্ষেত্র
২০২৫ সাল নারীদের জন্য ডিজিটাল সহিংসতার বছর হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সামাজিক মাধ্যমে ছবি বিকৃতি, ব্ল্যাকমেইল, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, ট্রলিং ও যৌন হয়রানির অভিযোগে বছরজুড়ে একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনাও।
‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করি’- এই স্লোগান সামনে রেখে আলোচনা হলেও বাস্তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গেছে। সঠিক আইন না থাকায় প্রয়োগের অস্পষ্টতা ও হয়রানির আশঙ্কায় অনেক নারী অভিযোগ করতেই ভয় পান। ফলে অপরাধীর সাহস বাড়ে, ভুক্তভোগী আরও একা হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তা আইন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাল্যবিয়ে
২০২৫ সালেও বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের নারী সহিংসতার অন্যতম নীরব কিন্তু গভীর সংকট হিসেবে রয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী বাল্যবিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও বাস্তবে এটি অনেক পরিবারে এখনও ‘সমাধান’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, যৌতুকের ভয় এবং কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ- এসব কারণ দেখিয়ে মেয়েদের অল্পবয়সেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
২০২৫ সালে বিভিন্ন পত্রিকা ও মানবাধিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দুর্যোগপ্রবণ ও গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিয়ের হার তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে স্কুল ছাড়া মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরিবার মনে করে- ‘বিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ।’ অথচ এর পরিণতি ভয়াবহ। অল্পবয়সে মাতৃত্ব, শারীরিক জটিলতা, মানসিক ট্রমা এবং শিক্ষা ও স্বপ্নের অপমৃত্যু- সব মিলিয়ে বাল্যবিয়ে একটি জীবনব্যাপী সহিংসতা। ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে নজরদারির ঘাটতি স্পষ্ট। অনেক বাল্যবিয়ে সামাজিক চাপে গোপনে সম্পন্ন হয়, যেখানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ পৌঁছায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন নয়- অভিভাবকদের মানসিকতা পরিবর্তন, মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোরদার না হলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়। বাল্যবিয়ে বন্ধ না হলে নারী সহিংসতা রোধের সব প্রচেষ্টাই অপূর্ণ থেকে যাবে- এই সত্য ২০২৫ সালেও আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শেষ কথা
২০২৫ সাল প্রমাণ করেছে- নারীর প্রতি সহিংসতা এখনও আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক ব্যর্থতা। আইন, ক্যাম্পেইন, দিবস পালন- সবকিছুর পরও যদি নারীরা নিরাপদ না হন, তবে অগ্রগতির গল্প অসম্পূর্ণই থেকে যায়। এ বছর নারীরা শুধু নির্যাতনের শিকার হননি- তারা প্রতিবাদও করেছেন, কথা বলেছেন, সহায়তা চেয়েছেন। সেই কণ্ঠগুলোই ভবিষ্যতের আশার জায়গা। ২০২৫-এর সালতামামি আমাদের মনে করিয়ে দেয়- নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়নই টেকসই নয়। সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবার- সবাইকে একসঙ্গে দায়িত্ব নিতে হবে। নইলে নতুন বছর এলেও নারীর বাস্তবতা বদলাবে না।
সুত্রঃ আমাদের সময়
