বাংলাদেশের উত্তরে জয়পুরহাটে একটি মাদ্রাসায় চারজন শিশু শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মাদ্রাসাটির শিক্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
সম্প্রতি দেশটির আরও কয়েকটি জায়গায় শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বিভিন্ন মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের খবর সংবাদমাধ্যমে আসায় বিশ্লেষকরা পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত এবং শিক্ষকদের অনেকে বলেছেন, যদিও তারা ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখেন, কিন্তু এনিয়ে তারা চিন্তিত এবং যৌন নিপীড়ন বন্ধে করণীয় ঠিক করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
জয়পুরহাট সদর উপজেলায় একটি নুরানী মাদ্রাসায় চারজন কন্যাশিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনে তাদের অভিভাবকরা মামলা দায়ের করেন গত রোববার। সেই মামলায় অভিযুক্ত মাদ্রাসাটির শিক্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
যে মাদ্রাসাগুলোতে শুধু কোরআন পড়ানো হয়, সে ধরণের মাদ্রাসাকে নুরানী মাদ্রাসা বলা হয়।
জয়পুরহাটে এমনই একটি মাদ্রাসার শিক্ষক গ্রেপ্তার হলেন শিশু শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে।
জয়পুরহাট সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসি মোঃ শাহরিয়ার খান বলেছেন, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার পরই তারা অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছেন।
“মোজাহিদপুরে নুরানী মাদ্রাসা বলে একটি মাদ্রাসা আছে। ওখানে স্থানীয় বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দিতো ভোরবেলা। এই যে কন্যা শিশু যারা শিক্ষার জন্য যায়, তারা ১২, ১৩ বা ১১ বছর বয়সের, এই সুযোগে ঐ শিশুদের যৌন নিপীড়ন করেছে। এই অভিযোগ নিয়ে তাদের মায়েরা আমার কাছে এসেছে। তখন আমি প্রাথমিকভাবে লোক পাঠিয়ে দেখলাম যে ঘটনাটা সত্য। এ ব্যাপারে মামলাও হযেছে। ঐ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে কোর্টে সোপর্দ করাও হযেছে।”
জয়পুরহাটের ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি দেশের আরও কয়েকটি জায়গায় মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে।
এরমধ্যে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় একটি মহিলা আবাসিক কওমী মাদ্রাসায় ১৩ বছর বয়সী এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসাটির হোস্টেল সুপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকদিন আগে।
ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি মাদ্রাসার দু’জন ছাত্রকে বলাৎকার করার অভিযোগে সেই মাদ্রাসার একজন শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই ঘটনাগুলোতে পুলিশ এখন তদন্ত করছে।
লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, আবাসিক মাদ্রাসা থেকেই শিশু শিক্ষার্থীদের শারিরীক নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বেশি আসে। এখানে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়কে তিনি অন্যতম একটি কারণ হিসাবে দেখেন।
“পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ যদি থাকে, সেখানে বাচ্চারা অনেক বেশি অনিরাপদ থাকে, বিশেষ করে সেখানে যদি বয়স্ক লোক থাকে। সামগ্রিকভাবে বাচ্চাদের অনিরাপদ পরিবেশটাই সমস্যা। এছাড়া বাচ্চারা এ ধরণের ঘটনা ঘটলে তা বলতে বা অন্য কাউকে জানাতে ভয় পায় এবং অনেক সময় তারা বিষয়টা বুঝতেও পারে না। এটাও একটা বড় কারণ।”
মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনেকে বলেছেন, যদিও এখন যৌন নিপীড়নের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে, তারপরও তারা এনিয়ে চিন্তিত।
মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনেকে বলেছেন, যদিও এখন যৌন নিপীড়নের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে, তারপরও তারা এনিয়ে চিন্তিত।
গত বছর ফেনীর সোনাগাজীতে একটি আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলার পর তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। যৌন নিপীড়ন এবং হত্যা মামলার বিচারে মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষসহ ১৬জনের ফাঁসির রায় হয়েছে।
সেই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এরপরও মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের অনেক অভিযোগ উঠছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে মাদ্রাসা শিক্ষক এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে, সেই কমিটির একজন সদস্য মোঃ ফয়জুল্লাহ বলেছেন, সম্প্রতি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যে সব অভিযোগ উঠছে, এই পরিস্থিতি নিয়ে তারা গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করছেন।
“বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই। তারপরও এগুলোর সমাধান কীভাবে করা যায়, সেজন্য আমাদের উদ্যোগ, চিন্তা এবং পরিকল্পনা আছে।”
মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না।
মানবাধিকার কর্মীদের আনেকে আবার মনে করেন, মাদ্রাসাগুলোর নিজস্ব বোর্ড বা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেখানেও ঘাটতি আছে।
মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান বলেছেন, কওমী, এবতেদায়ী বা নুরানী-বিভিন্ন ধরণের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মাদ্রাসার বোর্ডের কর্মকর্তারা বা শিক্ষকদের অনেকে কোন ঘটনায় ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ মানতে রাজি নন।
দেশে কওমী মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে ছয়টি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষাবোর্ড বেফাকের মহাপরিচালক জুবায়ের চৌধুরী বলেছেন, এখন বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ এলেও তারা চিন্তিত এবং করণীয় ঠিক করতে আলোচনা চালাচ্ছেন।
“সাদা কাপড়ে দাগ লাগলে, এটা ছোট হলেও খুব স্পষ্ট দেখা যায়। তো যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কথা আসছে, কিন্তু এটা নিয়ে আমরা অত্যন্ত চিন্তিত। আমাদের বোর্ডের মুরুব্বী যারা আছেন, তাদের সাথে করণীয় নিয়ে আলোচনা করছি।”
তিনি আরও বলেছেন, তারা কিছু পদক্ষেপও নিচ্ছেন।
“আমরা মাদ্রাসাগুলোকে ম্যাসেজ দিচ্ছে যেনো তারা সতর্ক থাকে। আমরা তাদের সংশোধন এবং সতর্কীকরণের মাধ্যমে এর সুরাহা করতে চাই।”
এদিকে দেশে এখন সামগ্রিকভাবে একের পর এক ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।-বিবিসি বাংলা