গত বছরের নভেম্বরে অসুস্থ মাকে দেখতে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে যাই । এরই মধ্যে গত ৯ নভেম্বর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে মিরপুরে একটি বাসায় বেড়াতে আসি । কাজ শেষে ফেরার পথে থেকে বের হওয়ার সময় মিরপুরে বি আরটির পিছনে পৌঁছালে ৩জন যুবক আমাদের পথরোধ করে আমার পরিচয় জানতে চাই, এই সময় আমি কারন জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় আপনাকে আমাদের খুব পরিচিত লাগছে। আমি আমার পরিচয় দিলে, একজন জানতে চাই আমি অস্ট্রেলিয়া থাকি কিনা এবং ব্লগে বা ফেসবুকে লেখালেখি করি কিনা। এই সময় আমি হ্যা বলার সাথে সাথে যুবকদের মধ্যে থেকে একজন দেশীয় অস্ত্র বের করে আমার মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমার বাম বাহুতে লাগে এই সময় আমার ছোট ভাই আমাকে নিয়ে দৌড় দেয়। ঘটনার আকস্মিতায় কিছুদূর যাওয়ার পর আমি পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হই এবং বাঁচার জন্য আমরা দুজনেই চিৎকার করতে থাকি। এই সময় কয়েকজন পথচারি আমাদের উদ্ধার এগিয়ে গেলে দুষ্কৃতিকারী পালিয়ে যায়। পরে পথচারিরা আমাদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আবার জীবননশের আংশকায় নির্ধারিত সময়ের আগেই অস্ট্রেলিয়া ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষদের খুন করা হচ্ছে। এ খুনের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, ধারাবাহিক ঘটনা। এ পর্যন্ত কেবল ব্লগ লিখে পরিচিতি পাওয়া এমন বেশ কয়েক জনকে হত্যা করা হয়েছে, এর বাইরে আছে মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও, আছে আক্রমণের ঘটনা। এসব ঘটনার মধ্যে কেবল রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা বিচারের পর্যায়ে আছে যদিও অনেক আসামি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বাকিগুলো নিয়ে মাতামাতি নেই, প্রশাসনেরও নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। লক্ষ্যণীয় বিষয়, সবগুলো হামলার ধরন একই এবং কারণও একই এবং দেশের সরকার, প্রশাসন খুনীদের ধরতে আন্তরিক নয়।
গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, হামলাকারীরা মনে করে মুরতাদ, নাস্তিক ও ইসলাম অবমাননাকারীদের হত্যা করতে হবে। অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট যাদের এ পর্যন্ত খুন করা হয়েছে তাদের দৃষ্টিতে এরা সকলেই মুরতাদ, নাস্তিক ও ইসলাম অবমাননাকারী। গুলি করে হত্যা করলে সওয়াব কম। তাই তরবারি, চাপাতি, রামদা অথবা চাইনিজ কুড়াল দিয়েই কুপিয়ে হত্যা করতে হবে। এর মধ্যে গলায় অথবা ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা করলে সওয়াব আরও বেশি। তাই তারা গলা অথবা ঘাড় টার্গেট করে সব সময় কোপ দেয়। ওরাতো আমাকে সেইভাবে টার্গেট করেছিল যে ভাবে করেছিল অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল), রাজিব হায়দার শোভন সহ আরো অনেকে। আমি হয়ত আজ নিহত ব্লগারদের তালিকায় স্হান পেতাম। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় এই যাত্রায় বেঁচে ফিরলাম।
আমার মতো মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন অনেক বাংলাদেশি ব্লগাররা। তবুও আমরা থেমে যেতে নারাজ। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, সেইখানে পরাজয়ে ডরে না বীর’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লাইনগুলো মনে এঁকে নিজেদের পথে এগিয়ে চলছি। কিন্তু এইভাবে কতটা পথ চলা যায়? নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেচে যাওয়ার পর সেই ভয় তাড়া করে ফিরে প্রতিনিয়ত। অবস্হা এতটাই গুরুতর আমাকে নিয়মিত মনোচিকিৎসা নিতে হয়। পাল্টে গেছে আমার চলার রুটিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ব্লগে কোন পোষ্ট দিতে অনেক ভয় হয়। তাই লেখালেখি করতে গেলে আতংকিত বোধ করি। যদি অস্ট্রেলিয়াতে থাকি তবু ওদের ভয় আমাকে তাড়া করে ফেরে। জানি না এই জীবনে আর স্বাভাবিক হতে পারব কিনা।
সক্রেটিস ভক্তরা চেয়েছিল সক্রেটিসের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা; কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র চায়নি সক্রেটিসের এমন মৃত্যু হোক। আমরাও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করি, জীবন নিয়ে ভাবি, সমাজকে উপলব্ধি করি, আর অপেক্ষা করি কখন স্বাভাবিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে।
কিন্তু আসলে কি আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাচ্ছি? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কি আমরা এমন কোনো পৃথিবী তৈরি করতে পেরেছি, যেখানে তারা স্বাভাবিক মৃত্যুর আশা করতে পারে?
মৃত্যু থেকে কয়েক এক হাত দুরে
previous post