বিয়ে হয়ে থাকে দুটি মানুষের মধ্যে। এর একজন নারী, অপরজন পুরুষ। শুধু নারীর বেলায় তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় জেনে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ প্রকাশ্যে আনতে হবে, পক্ষান্তরে পুরুষের বেলায় কোন প্রশ্নই তোলা হবে না। এমন নিয়ম বিস্ময়করই বটে। মুসলিম রীতিতে বিয়েতে কাবিনের জন্য প্রয়োজন হয় কাবিননামা। কাবিননামার ফরম পাকিস্তান আমলে তৈরি। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ বসানো ছাড়া আর কোন সংশোধন না করা ছিল দুঃখজনক। প্রায় অর্ধশতক পরে বিষয়টির নিষ্পত্তি হলো। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই যে এর জন্য দায়ী তাতে কোন সন্দেহ নেই। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিসিদ্ধ উপায়ে পরস্পরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সংসার জীবনে প্রবেশ করে থাকে। সেক্ষেত্রে নারীর কুমারিত্ব বড় হয়ে দেখা দেয়ার বিষয়টি মান্ধাতা আমলের, অর্থাৎ পশ্চাৎপদ, অনাধুনিক ও কুসংস্কারপূর্ণ। এটি শুধু কি কনের জন্যই অস্বস্তির? বিবেকবান ও মানবিক বরের জন্যও এটি ছিল অস্বস্তি ও বিব্রতকর। সে নিজে ‘কুমার’ কিনা সেই প্রশ্ন এড়িয়ে কেবল নারীর একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য জানার রেওয়াজ ছিল, যা মোটা দাগে বৈষম্যমূলক।
এছাড়া একজন নারীকে যৌনতার দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে তাকে কুমারী বা সতী বলে আখ্যায়িত করা ভুল। অথচ এ ভুল ধারণাই হলো বিয়ের কনের স্বভাব-চরিত্র, এমনকি তার পরিবারের ভাল মন্দ বিচার করার মাপকাঠি।
নির্মম হলেও সত্যি যে, কোন পুরুষের যৌনলোলুপতার শিকার হয়ে রেপ, এসিড নিক্ষেপ ইভটিজিং সহ অন্য কোন হয়রানি শিকার হলে ; মেয়েটি হারায় তার কুমারীত্ব। আর এমন মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে মা বাবা। কারণ মেয়েটি আর কুমারী থাকে না সমাজের দৃষ্টিতে।
দেশে মুসলিম বিয়ের কাবিননামা হিসেবে পরিচিত রেজিস্ট্রেশন ফরমের (নিকাহনামা) ৫ নম্বর কলাম থেকে ‘কুমারী’ শব্দ বাদ দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, নারীপক্ষ এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ওই রায় দেয়া হয়।স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটি হতে পারত বহু আগেই। বিলম্বে হলেও এটি স্বস্তিকর। নারী সমাজের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল এটি। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। নারী-পুরুষের মধ্যে বিভেদকামী এবং এক ধরনের সূক্ষ্ম অন্যায্যতা থেকে মুক্ত হলো বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত লজ্জাকর বিষয়টির অবসান ঘটেছে। আগামী দিন থেকে যারা বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন তাদের ভেতর আর কোন সূক্ষ্ম অপমানবোধ থাকবে না, এটি পরম সুখের বিষয়।