আজকাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কথার ফাঁকে যেকোনো প্রসঙ্গে এই শব্দগুলোর উল্লেখ প্রায়ই শোনা যায়। বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিল এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে, সেগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা যায়। ওয়া ছিল, বৈষম্যের অবসান। বাঙালি সম্প্রদায় যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করত, তাদের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হতো। তাদের প্রতি পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদির ফলে বাঙালিরা পাকিস্তানের অন্য নাগরিকদের তুলনায় নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করত।দুঃখের বিষয় হলো, অনেককে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে ঠিক এর বিপরীত কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে লালন করে আমাদের এই দেশটি স্বাধীন করা হয়েছিল। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কতটুকু এখন বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে অনেক কিছুই হচ্ছে, অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে কি কি বিষয় ছিল সে বিষয়গুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আমরা সেই চেতনাকে ভুলে গেছি অথবা জানা থাকা সত্বেও ভুলে যাওয়ার ভান করছি।
নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে নির্বাচিত করে নেতা বানিয়েছে। নুরের কার্যালয়ে আলো নিভিয়ে (নিজেদের আড়াল করতে) যেভাবে হামলা হয়েছে, তা সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়। এমনকি হামলাকারীদের নির্দয় আঘাতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এক নেতাকে লাইফ সাপোর্টে পর্যন্ত নিতে হয়েছে। একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর দাঙ্গাবাজির কায়দায় বারবার এবং প্রকাশ্যে হামলা কেন? ঢাকার বাইরেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন এই ভিপি। এভাবে বারবার প্রাণঘাতী হামলা হচ্ছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ কিংবা সরকার কেউ তাকে ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে পারছে না। প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ থেকে বলা হয়েছে, সেখানে ডাকসু ভবনে নুরুর সঙ্গে বহিরাগতরা ছিল। নুরু তা স্বীকার করেই বলছেন, তিনি অনিরাপত্তাজনিত কারণে একা চলাফেরা করেন না। যদি প্রশাসন বহিরাগত বিষয়টিকেই জোর দেয় তাহলে প্রশ্ন, নুরুর নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল?
‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ সংগঠনটির কর্মী পরিচয়ে এর আগেও নুরুলসহ একাধিক ছাত্রনেতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাদের খুঁটির জোর কোথায়? হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনের নেতারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার কথা নয়। কিন্তু তারা করেছে। এটা নিছকই গু-ামি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে পবিত্র বিষয়। এ নাম নিয়ে সংগঠন বানিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- করা ঘৃণ্য কাজ। কারা এসব সন্ত্রাসী কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নাম দিয়ে কেউ এ ধরনের কাজ করলে তা সমর্থনযোগ্য নয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ঘৃণার আগুন যেন মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র নাম স্পর্শ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে দায়ী সব নেতাকর্মীর বিচার ও শাস্তি দেওয়া জরুরি।
এ ধরনের বেআইনি ও অমানবিক কাজে উসকে দিয়ে সরকারের অবশিষ্ট ভাবমর্যাদা ডোবাচ্ছে কারা। কারা কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলে আনন্দ পাচ্ছে। সরকার নিজের দায়মুক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন এবং রাষ্ট্রের ওপর থেকে অভিযোগের আঙ্গুল সরানোর জন্য হলেও আইন, বিচার ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে খেলা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। সরকারের বোধোদয় না ঘটলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং জনমনে অবিশ্বাসের যে ডালপালা গজাচ্ছে, তার শেষ ভালো হওয়ারও কথা নয়।
পরিশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে দুটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে আমার এ লেখার পরিসমাপ্তি টানছি। এক. বঙ্গবন্ধু ৫০-এর দশকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে দেয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি”। দুই. “মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না”।
1 comment
এক নুরুর কাছে আওয়ামীলীগ ধরাশায়ী পুলিশ না থাকলে এদের দেশে খুজে পাওয়া যেত না