নারীপাচারকারীরা কৌশল পাল্টে এখন মাজারকে নিশানা করেছে। দেশের বিভিন্ন মাজারে আসা-যাওয়া করা নারী, যাঁরা বয়সে তরুণী, তাঁদের চাকরির প্রলোভন দিয়ে ভারতে পাচারের নতুন ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, টিকটক, লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে তৈরি নাটক, সিনেমায় অভিনয়ের কথা বলে তরুণীদের ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর পাচারকারীরা এখন ধর্মীয় লেবাসে অপকর্মে নেমেছে। মাজারকেন্দ্রিক পাচারকারীচক্র নারীদের ভারতের আজমির শরিফ দরগাহ জিয়ারত করে পুণ্য লাভ করার বা চাকরি দেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলছে। এভাবে পাচারের শিকার দুই তরুণীকে সম্প্রতি দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এই দুই তরুণীকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখে ‘রাইটস যশোর’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন।
ওই সংগঠনটির সূত্রে জানা গেছে, পাচারের শিকার দুজনের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। তাঁদের মধ্যে একজন (২০) বাবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে সংসারে অশান্তির মধ্যে ছিলেন। মানসিক প্রশান্তির জন্য স্থানীয় একজনের পরামর্শে তিনি রাজধানীর একটি মাজারে মানত করতে আসেন। সেখানেই পরিচয় হয় ধর্মীয় লেবাসধারী এক ব্যক্তির সঙ্গে। ওই ব্যক্তি তাঁকে খেতে দিয়েছিলেন। এরপর বাড়ি যাওয়ার জন্য ৫০০ টাকাও দেন। এতে ওই ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা তৈরি হয় তরুণীর। পরে প্রতিবেশী আরেক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে ওই মাজারে আসা-যাওয়া শুরু করেন তিনি। আর লেবাসধারী ওই ব্যক্তির সঙ্গেও আলাপ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে দুই তরুণী তাঁদের পরিবারের দরিদ্র দশার কথা বললে ওই ব্যক্তি ভারতের রাজস্থানের আজমির জেলায় অবস্থিত সুফি সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরগাহে চাকরির প্রলোভন দেন। প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পাবেন শুনে দুই তরুণী ভারতে যেতে রাজি হয়ে যান। কয়েক মাস আগে এক রাতে তাঁদের দুজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে। কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁরা বুঝতে পারেন পাচারকারীর ফাঁদে পড়েছেন। কলকাতার একটি বাড়িতে তাঁদের দুজনকে প্রায় দেড় মাস রেখে যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। তাঁদের অন্যত্র সরানোর জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় সেখানকার পুলিশ তাঁদের আটক করে। এর পরই বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা। পরে দুই তরুণীকে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সেফ হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ভারতীয় দালালকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
রাইটস যশোরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এস এম আজহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই তরুণীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। কিছুদিন আগে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মাজার থেকে নারীদের সংগ্রহ করে পাচার করার তথ্য আমরা পেয়েছি।’
তবে আজহারুল ইসলাম বলেছেন, দুই তরুণীকে উদ্ধারের পরই তাঁরা পাচারকারীদের মাজারকেন্দ্রিক তৎকারতা সম্পর্কে জানতে পারেন। এর আগে এমন ঘটনা তাঁদের নজরে আসেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের কানে এসেছে। গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি। যারা ছদ্মবেশ নিয়ে এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কারা কিভাবে নারী পাচার করছে, কী কৌশল নিচ্ছে, সেদিকে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। কয়েক দিন আগে ইরাকে নারীপাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে পাচার করা হয়েছে। এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।’
রাইটস যশোরের তথ্য বলছে, গত সাত বছরে সংগঠনটি এক হাজার ১২১ জনকে ভারত থেকে ফেরত আনতে পেরেছে বাংলাদেশে। তাদের কাছে খবর রয়েছে যে বর্তমানে ভারতের সেফ হোম ও কারাগারে পাচারের শিকার অন্তত দুই সহস্রাধিক বাংলাদেশি নারী-পুরুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নারী ৯৫ শতাংশ। নারীরা ভারতীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর তাঁদের শেল্টার হোমে রাখা হয়। আর পুরুষদের রাখা হয় কারাগারে। রাইটস যশোর এখন ভারতে পাচার হওয়া ১৩০ জনের মতো ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগঠন ইরাক, লেবাননসহ ১০টি দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করে।
এ ছাড়া অন্যান্য এনজিও পাচারের শিকার নারী-পুরুষ, যাঁরা ভারতে আটক অবস্থায় আছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে।
ফেরত আসা নারীদের মধ্যে যশোরের কেশবপুরের একজন প্রায় তিন বছর পর ফিরতে পেরেছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে পাচারের শিকার হন। তাঁকে ২০১৭ সালে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। উদ্ধারকারীদের ওই নারী জানিয়েছেন, দালাল তাঁকে ভারতের মধ্য প্রদেশের জলি ও ভিকি (বিষ্ণুপ্রতাপ সিং ভাদুরিয়া) দম্পতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাঁকে যৌনবৃত্তিতে লাগানো হয় এবং একাধিকবার তাঁকে বিক্রি করা হয়। প্রথম দিকে তাঁকে ইনজেকশন দেওয়া হতো। ইনজেকশন দেওয়ার পর তিনি সবই দেখতেন, বুঝতেন কিন্তু নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকত না। মুম্বাই, নাগপুরসহ বিভিন্ন শহর ঘুরিয়ে নানাভাবে তাঁকে ব্যবহার করার এক পর্যায়ে ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নাগপুরের বলধা রোডের একটি হোটেল থেকে ভারতীয় পুলিশের অপরাধ বিভাগ তাঁকে উদ্ধার করে। আদালতের নির্দেশে তাঁকে একটি শেল্টার হোমে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাইটস যশোরের সহায়তায় ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
নারীপাচারের তথ্য-তালাশ নিতে গিয়ে জানা গেছে, বিয়ে করে ভারতে পাচারের ঘটনা পুরনো একটি বিষয়। এখনো সেটি অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া বছর দুয়েক আগে পাচারকারীচক্রের সদস্যরা নাটক-সিনেমার পরিচালক সাজতে শুরু করে। দরিদ্র তরুণীদের তারকা বানানোর প্রলোভন দিয়ে ভারতে শুটিংয়ের কথা বলে নিয়ে যেত। আর সেখানে নিয়ে তারা তাদের বিভিন্ন পতিতালয়, ড্যান্স ক্লাবে বিক্রি করে দিত। কয়েক মাস আগে ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর টিকটক হৃদয় চক্রের অনেক সদস্য ধরা পড়ে। তখন জানা যায়, চক্রটি ভারত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নারীদের পাচার করত। তবে এ ধরনের চক্রের অনেক সদস্যই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
টিকটক ও লাইকি অ্যাপ ব্যবহার করে নাটক, সিনেমা বা গানের ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে অনলাইনে প্রচার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, যে চক্রটি একসময় দেশে টিকটক কনটেন্টে নায়িকা বানানোর কথা বলে ভারতে নারী পাচার করত, তারাই এবার কৌশল পাল্টে ধর্মীয় লেবাস নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মাজারের দিকে নজর দিয়েছে। তারা সহজ-সরল নারীদের নিশানা করে। এরপর তাদের পুণ্য লাভের জন্য ভারতের আজমির শরিফে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই যাওয়া-আসার খরচ দেওয়ার কথা বলে তরুণীদের রাজি করায়। তরুণীরা বিনা পয়সায় ভারতে যাওয়া-আসার লোভে পড়ে রাজি হয়ে যান। এ ছাড়া মাজারে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনও দেয় তারা। এতে দরিদ্র তরুণীরা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন।
গত ২ সেপ্টেম্বর পাচারের শিকার সাত তরুণীকে ‘জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার’ নামের একটি সংস্থার সহযোগিতায় দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের ভারতে পাচার করার দুই বছর পর ফেরত আসতে পেরেছেন এই তরুণীরা।
জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শাওলী সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাচারকারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের চাকরির প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যায়। ইদানীং টিকটক, লাইকির মাধ্যমে চক্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পাচারের শিকার হচ্ছে তরুণীরা। তাদের নিয়ে ড্যান্স বারে, পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘পাচার থেকে রক্ষা পেতে হলে লোভে পড়া যাবে না। একজন গার্মেন্টকর্মী আট থেকে ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। তাকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতনের প্রস্তাব দিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করে, এমন তথ্য পাই আমরা। সবাইকে সচেতন হতে হবে। কোথায় কার মাধ্যমে কোথায় যাচ্ছে এসব জেনে গেলে এ সমস্যায় পড়তে হয় না।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলছেন, মানবপাচার ঠেকাতে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। পাচারের শিকার হওয়া নারী-পুরুষদের বিদেশ থেকে ফেরত আনতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন। বিভিন্ন এনজিও এ নিয়ে কাজ করে।
সুত্র: কালের কন্ঠ
6 comments
সমাজে নারী পাচারকারীরা নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে নারী পাচার করছে এদের ধরে সরাসরি ক্রস ফায়ার দেয়া উচিত
নারীদের আরো সচেতন হতে হবে বিশেষ সরকারে আরো বেশি করে ইলেকট্রিক মিডিয়ার মাধ্যমে নারী পাচার সর্ম্পকে তথ্য প্রচার করতে হবে।
সবাই চায় একটু সুন্দর আর্থিক স্বচ্ছলতা আর জানোয়ার গুলো এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিরীহ সহজ সরল নারী দের পাচার করে
অল্প বয়সী তরুনীরা বাবা-মায়ের দারিদ্রতা দূর করতে পাচারকারী এই পাতানো ফাঁদে দিয়ে বিপদে পড়ে তাই আরো সচেতন হতে হবে।
নারী পাচারকারী দেশ ও সমাজের শত্রু এদের চিহ্নিত বিচারের আওতায় আনা কঠিন কাজ নয়
নারী পাচারকারীর কি কোন মা- বোন ছাড়া অটোমেটিকভাবে পয়দা হইছে জানি না জানোয়ারে বাচ্চাদের কোন বিভেগ নাই