বিনিয়োগের মাধ্যমে সুদবিহীন উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে মানুষকে আকৃষ্ট করতে কিছু আলেমকে দিয়ে ওয়াজের ব্যবস্থা করতেন এহসান গ্রুপের (এহসান এস) চেয়ারম্যান মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান। এমনকি বিদেশ থেকে আলেম এনেও প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। আর বক্তাদের কথা বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি কর্মী হয়ে মানুষের কাছ থেকে জামানত সংগ্রহ করে দিয়েছেন অনেকে। এভাবেই পিরোজপুরের রাগীবের ঘনিষ্ঠ জামায়াত-শিবিরের কিছু কর্মীকে নিয়ে এহসান গ্রুপ বড় আকার ধারণ করে। এহসান গ্রুপের প্রতারণা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর এখন তোপের মুখে পড়েছেন সাধারণ কর্মীরা। আর গা-ঢাকা দিয়েছেন প্রতারকচক্রের ওই সব জামায়াতপন্থী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আলেমদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন রাগীব। পিরোজপুর, যশোর, নড়াইল, কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সক্রিয় এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করে এক হাজার ২০০ মাঠকর্মী এবং লক্ষাধিক গ্রাহক বিপাকে পড়েছেন। গ্রাহকদের তোপ থেকে বাঁচতে র্যাব-পুলিশের সাহায্য চাইছেন কর্মীরা।
এদিকে বিপুল পরিমাণ সম্পদে বিনিয়োগের কথা বলা হলেও বাস্তবে এহসান গ্রুপের তেমন সম্পদ খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যশোরে ১৫ হাজার গ্রাহকের ৩২২ কোটি ১১ হাজার ৭৫০ টাকা বিনিয়োগ থাকলেও সদর উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকায় আট বিঘা এবং যশোর-নড়াইল সড়কের দাইতলায় হামকুড়া ব্রিজ এলাকায় ১৭ বিঘা জমি ছাড়া আর কোনো সম্পদের হদিস মিলছে না। এসব জমিও এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দৃশ্যমান সামান্য কিছু সম্পদ থাকলেও এসব বিক্রি করে টাকা পাচার করেছেন রাগীব ও তাঁর সহযোগীরা।
অন্যদিকে র্যাব ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ধর্মকে ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগের নামে আত্মসাতের কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন রাগীব। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর তোপখানা এলাকা থেকে ভাই আবুল বাশার খানসহ তাঁকে গ্রেপ্তারের পর পিরোজপুর পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। পিরোজপুর থানায় রাগীব ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। পিরোজপুরের পুলিশ বৃহস্পতিবারই রাগীবের অপর দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খায়রুল ইসলামকে তাঁদের নিজ গ্রাম খলিশাখালী থেকে গ্রেপ্তার করে। আদালতের নির্দেশে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের সূত্র বের করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটির’ সাধারণ সম্পাদক যশোরের বারান্দীপাড়া কদমতলার মফিজুল ইসলাম ইমন জানান, কার্যত ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। পর্যায়ক্রমে এহসান সোসাইটি ও এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নাম নিয়ে যশোরে তাদের প্রতারণা শুরু হয়। মূলত এহসান এস বাংলাদেশ, এহসান রিয়েল এস্টেট ও এহসান মাল্টিপারপাস শরিয়া মোতাবেক সুদবিহীন ব্যবসার ধুয়া তুলে মাসে এক লাখে ১৬০০ টাকা মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা জমা নিতে থাকে। এই কাজে যশোরের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ সরল বিশ্বাসে এখানে লগ্নি করে।
ফেসবুকে এহসান গ্রুপের নামে ওয়াজের বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে ওয়াজকারীরা এহসান গ্রুপে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রাহক ও কর্মীরা বলছেন, শরিয়াসম্মত বিনিয়োগের এই আহ্বানে তাঁরা অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন।
বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কোটি কোটি লগ্নি হিসেবে হাতিয়ে নিলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লভ্যাংশ বা আসল ফেরত দেওয়া হয়নি। আজ দেব কাল দেব বলে টালবাহানা শুরু করলে বিপাকে পড়েন লগ্নিকারীরা। এক পর্যায়ে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে গাঢাকা দেন এহসান এসের কর্মকর্তারা।
এই পর্যায়ে গ্রাহকদের টাকা উদ্ধারে গঠন করা হয় ‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটি’। কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমন আরো বলেন, যশোর অঞ্চল থেকে ৩২২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মূলত জড়িত এহসান গ্রুপের এহসান এস বাংলাদেশ ও রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের মুফতি আবু তাহের নদভী, এহসান এস যশোর শাখার ব্যবস্থাপক আতাউল্লাহ, প্রধান নির্বাহী অর্থ মহাব্যবস্থাপক মুফতি জুনায়েদ আলী ও ক্যাশিয়ার আইয়ুব আলী। তাঁদের বিরুদ্ধে আগেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হয়। মামলাও দায়ের করা হয়, যা তদন্ত করে পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআই। তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও মেলে। ৫৬ জন বিনিয়োগকারী টাকার শোকে মারা গেছেন এমন জনশ্রুতিও আছে। এত কিছুর পরও রাগীব এত দিন ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিলেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জনে রাগীব তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে ওয়াজের আয়োজন করতেন। বিদেশ থেকে ধর্মীয় বক্তাদের এনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বক্তব্য দেওয়াতেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এভাবে টাকা নিয়ে তিনি আবাসন ব্যবসা ও জমি কেনায় বিনিয়োগ করেছেন। রাগীব এ ধরনের সাত-আটটি প্রকল্প থাকার কথা স্বীকারও করেছেন। তবে হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা নিয়ে তিনি নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়েছেন।
পিরোজপুর সদর থানার ওসি মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, রাগীব ও তাঁর তিন ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অভিযোগের ব্যাপারে জানা যাবে। তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। আবার ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়েও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, রাগীবের ভাই মাহমুদুল পিরোজপুর বাজার মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাগীবের বাবা মাওলানা আব্দুর রব, শ্বশুর শাহ আলমসহ তাঁদের পরিবার জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সঙ্গে এই পরিবারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এলাকায় জামায়াত ও ধর্মীয় নেতা বলে তাঁর একটি অনুসারী দল তৈরি হয়েছে। তাঁদের অনেকেই এহসান গ্রুপের কর্মী। কিছু জামায়াত কর্মীও এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয়। তাঁরা রাগীবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তাঁরা এখনো সক্রিয় থেকে গ্রাহকদের ঠেলে দিচ্ছেন সাধারণ কর্মীদের দিকে।
পিরোজপুরের মাঠকর্মী মাওলানা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকে আলেমদের দেখে না বুঝে বিনিয়োগ করেছেন। আমরা কাজ করেছি। অনেকে তাঁদের ঘনিষ্ঠ। তাঁদের এখন পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কর্মীরা আমাদের এসে ধরছে।’
সুত্র: কালেরকন্ঠ
10 comments
কুয়াকাটার বাটপার এবার ধরা পড়ছে
ধর্মীয় লেবাসধীরা হুজুর কুয়াকাটা হাফিজুর রহমান ওয়াজ মাহফিলে তার অনুসারীদের এহসানে বিনিয়োগের জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন ওকে ধরা উচিত।
আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন ঈমাম দিয়ে টাকা কালেকশন ও করিয়েছেন এখন এই ঈমামরা ও মানুষের কাছে অসহায় হয়ে গেছে
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে এদের প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবী জানাচ্ছি
ওয়াজ- মাহফিলের আড়ালে নিজের প্রতারণামূলক ব্যবসা চালিয়ে এভাবে হাজার হাজার মানুষের টাকা আত্নসাত করার মাধ্যমে এরা যেভাবে ইসলামের ক্ষতি করছে সেটা বর্ণনাতীত। সমাজের ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসকে এরা সুযোগ হিসেবে লুফে নেয়
এত বছর কিভাবে এত বড় প্রতারণা করলো ? আমার বিশ্বাস আরো বড় বড় প্রতারক আছে। আরো জোড়ালো তৎপরতা চালালে এদের সবাইকে ধরা সম্ভব।
এই সকল ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দেশবাসী সচেতন হওয়া উচিত
সব শয়তান গুলোকে দ্রুত ফাঁসি দিন যাতে আর কোন কেউ এরকম বাটপারি করে মানুষের টাকা মেরে না খায়।
আওয়ামী সরকারের উচিত এই দালালটাকে (হাফিজুর রহমান) গ্রেফতার করে নিজেদের পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করা৷
অসৎ এবং প্রতারকের পক্ষে সাফাই গেয়ে হাফিজুর রহমান প্রমাণ করেছে সে নিজেও একটা ভন্ড এবং পথভ্রষ্ট তথাকথিত আলেম।