‘ওয়ান বিলিয়ন রাইসিং’ বা ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ নারী নির্যাতন বন্ধে গঠিত বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে এই আন্দোলন শুরু করেন মার্কিন নাট্যকার ও মানবাধিকারকর্মী ইভ এনসেলার। এটি শুরু হয় ২০১৩ সালে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বে আফগান নারীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধে সমাবেশ হয় এই নেটওয়ার্কের উদ্যোগে। রাজধানী ঢাকাতেও হয় সমাবেশ। সমাবেশে ছয় আফগান নারীর আত্মসাক্ষ্য তুলে ধরা হয়। সাক্ষ্যে এই ছয় নারী বলেছেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর তালেবানের ভয়াবহতার কথা।
ফাতিমা
আমার নাম ফাতিমা। তালেবান যেদিন প্রথম কাবুলের দখল নিল, আমার সন্তানেরা বাড়ির বাইরে ছিল। চারদিকে ভীষণ শোরগোল এবং সবাই তালেবানের ব্যাপারে আতঙ্কিত ছিল। আমি খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম এবং বারবার বাড়ির বাইরে যাচ্ছিলাম আবার ফেরত আসছিলাম, ভাবছিলাম তালেবানরা তাদের অপহরণ করল কি না। এক এক করে আমার বাচ্চারা ঘরে আসে। আমি বুঝতে পারছিলাম, কীভাবে দুশ্চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেছি। তালেবানরা আসার আগে আমি স্কুলে গেছি, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি, ছয় বছর ধরে জিমে গেছি, সেখানে আমি একজন প্রশিক্ষক ছিলাম। এখন আমার কিছুই নেই, কোনো কাজ নেই, শুধু ঘরে বসে আছি। আমার স্বামীরও চাকরি নেই, সে ঘরেই থাকে। আমরা জানি না, ঈশ্বর আমাদের ভাগ্যে কী রেখেছেন, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।
মানুষ তালেবানকে ভয় পায়। কারণ, তারা মানুষকে আঘাত করছে। আমরা বেশির ভাগ মানুষ ঘর থেকেই বের হই না এবং সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকি। যদিও তালেবানরা বলে যে তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু আমরা তালেবানের আগের শাসনামলের ভয়াবহ স্মৃতি বহন করছি। আমরা মনে করি না যে তাদের আচরণের কোনো পরিবর্তন হয়েছে। আমরা তাই খুবই ভীত ও সন্ত্রস্ত।
লাইলুমা
আমি লাইলুমা। আমি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতাম। আমার দেখাশোনা আমার নিজেকেই করতে হয়। ২৩ বছর আগে আমার স্বামী এবং আড়াই বছর আগে আমার ছেলে শহীদ হয়। আর এখন আমি ঘরের কোনায় বসে আছি। কোনো জীবিকা নেই, আয়রোজগার নেই। কীভাবে বেঁচে থাকব, কিছুই জানি না। কেউ সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেনি। আমাকে বাধ্য হয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়…কর্মহীন আর প্রচণ্ড হতাশ হয়ে। কী করব আমি? আমার কন্যা, ভাতিজা আর আমি—তিনটি মানুষ অসহায়ভাবে ঘরে বসে আছি। আমার স্বামী নেই, ছেলে নেই, অথচ আমি মন্ত্রণালয়ে কাজ করে আমার সংসারের মানুষগুলোর মুখে অন্ন জুগিয়েছি, তাদের ভরণপোষণ করেছি। এখন এই আমাকে ঘরে বসে থাকতে হয়, ঈশ্বর ছাড়া আমাদেরকে দেখার আর কেউ নেই। আমি আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলাম, এখন আমাদের আর কোনো উপায়ও নেই।
নার্গিস
আমার নাম নার্গিস। আমি আফগান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে সংগীত বিষয়ে পড়াশোনা করছিলাম। মাত্রই আমি একাদশ পাস করেছি। গত আট বছর আমি একজন গিটারিস্ট হিসেবে পরিচিত। যেদিন তালেবানরা আমাদের স্কুলে ঢুকল, আমরা তখন অনুশীলন করছিলাম। আমরা দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে আসি। তারা এখনো রাতদিন সেখানেই অবস্থান করছে। তারা মনে করে, সংগীত হারাম। আমাদের স্কুলে যত সংগীতের যন্ত্র ছিল, তারা তা সবই ভেঙে ফেলেছে।
নারীরা তাঁদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তুলছেন, প্রতিবাদ করছেন। এই প্রতিবাদে আমরাও অংশগ্রহণ করেছি। কারণ, নারীরা তাঁদের এত বছরের কষ্টের অর্জনকে ব্যর্থ হতে দিতে চান না, তাঁরা আবারও গৃহবন্দী হতে চান না। তাঁরা বেরিয়ে আসবেনই, আওয়াজ তুলবেনই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীরাও আওয়াজ তুলবেন, যাঁরা নারীর অধিকারের বিষয়ে সচেতন ও সোচ্চার। আমরা চাই, তাঁরাও আফগান নারীদের সঙ্গে থাকবেন, আমাদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হবেন।
নুরিয়া
আমি ডাক্তার নুরিয়া। কাবুল শহরের একটি হাসপাতালের স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ। তালেবান যখন কাবুল শহর দখল করল, আমরা সবাই মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ অনেক হইচই শোনা গেল, মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরছিল, সবার মনে ভয়ের ছায়া আর আতঙ্ক। তালেবানরা হাসপাতালেও ঢুকল। নারীদের জীবনে নেমে এলো ঘন অন্ধকার। কাবুল যেন এক মৃত নগরীতে পরিণত হলো, কেউ আর ঘর থেকে বের হয় না, সবার কণ্ঠ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন নারী চিকিৎসক হিসেবে বিভিন্ন নারী-অধিকার আদায় ও সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছি। নারীদের জন্য হাসপাতালে কাজ করি ঠিকই, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে ভয়ে থাকতে হয়, কখন তারা আমার কোন ক্ষতি করে। কারণ, নারীদের সঙ্গে তারা খুব অসম্মানজনক আচরণ করে, নারীদের তারা মানুষই মনে করে না। তারা চায়, নারীরা যেন ঘরের বাইরে না বেরোয়।
আমি নারীদের প্রতিবাদ আন্দোলনগুলোতে অংশ নিয়ে থাকি। আমি অনুরোধ জানাই সেসব সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও নারীকে—আমাদের এই অবস্থায় একা ছেড়ে দেবেন না। আফগান নারীদের এত দিনের অর্জন যেন ব্যর্থ না হয়, এই অতল অন্ধকারের মধ্যে থেকে আমরা যেন বেরিয়ে আসতে পারি, আমাদের পাশে দাঁড়ান। যেভাবে নারীদের মৌলিক অধিকার হরণ করে তাঁদের ঘরের মধ্যে বন্দী করা হয়েছিল, সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। সব দেশের মানুষের কাছে আবেদন জানাই, আমাদের সহযোগিতা করুন, আমাদের কণ্ঠ যেন রুদ্ধ না হয়ে যায়।
রোকিয়া
সবাইকে শুভেচ্ছা। আমি রোকিয়া সিদ্দিকী। আমি একজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলাম ও সাংবাদিকতা করতাম। তালেবানের আসার আগে আমি আফগানিস্তানের উত্তরের প্রদেশগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছি। আফগানি নারীদের শিক্ষা, নিরাপত্তা, জীবন ধারণ, বঞ্চনা ইত্যাদি বিষয়ে আমি আফগান নারীদের সাক্ষাৎকার নিতাম। এগুলো আমার গবেষণার বিষয় ছিল এবং হফতা-নাম-এ কাবুলে এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তালেবান আসার পর আমার জীবনের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। সব শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। আমার সরকারি চাকরি আমি চালিয়ে যেতে পারিনি। কারণ, আমার কাজ ছিল শহরাঞ্চলের বাইরের অঞ্চলগুলোতে জরিপ চালানো ও গবেষণা করা, যা এখন আর আমি করতে পারি না। সাংবাদিক হিসেবে যা লিখতে চাই, তা আর এখন লিখতে পারি না। তালেবানরা সাংবাদিকদের হুমকি দেয়, আপনারা নিজেরাই দেখেছেন, কীভাবে সাংবাদিকদের মারধর করা হচ্ছে, তাঁদের ওপর নির্যাতন ও অত্যাচার করা হচ্ছে। আমি আর কখনোই সাংবাদিকতা করব না। কারণ, আমি চাই না আমার জন্য আমার পরিবার অনিরাপদ আর অরক্ষিত হয়ে যাক, বা আমার প্রতি কোনো অবিচারের ভয়ে তারা সন্ত্রস্ত থাকুক। তাই আমি এখন আর কোনো কাজ করি না, লেখালিখিও করি না। আমি কোনো প্রতিবাদেও অংশ নিইনি। এর একমাত্র কারণ, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি, আমি চাই না আমার কারণে আমার পরিবার দুশ্চিন্তায় থাকুক। পৃথিবীর সব নারীর প্রতি আমার আবেদন, তাঁরা যেন আফগান নারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। কারণ, আফগান নারীরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে অরক্ষিত ও নিপীড়িত অংশ।
গত কুড়ি বছরে আফগান নারীরা নানান রকম শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, পুরুষের পাশাপাশি কাজের মাধ্যমে নিজেদেরকে যোগ্য প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। কিন্তু তালেবানের পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আবার গৃহবন্দী হয়ে গেছেন। যে স্বল্পসংখ্যক নারী কাজ করছিলেন, তাঁরা এখন ভীষণ রকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, হয়তো যেকোনো মুহূর্তে ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যেকোনো সময়ে তালেবানের একটি বুলেট স্তব্ধ করে দিতে পারে তাঁদের জীবনের সব অর্জন; ক্ষতি করতে পারে তাঁদের পরিবারের।
জাহরা
আমি জাহরা, ইরানের সুন্দর শহর ইসফাহানে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ফারাভার বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস বিষয়ের ছাত্রী আমি। চিকিৎসাশাস্ত্রে আমার পড়ার ভীষণ আগ্রহ ছিল, কিন্তু দুঃখজনকভাবে আফগান উদ্বাস্তু ছেলেমেয়েদের জন্য ইরানে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ার সুযোগ ছিল না। শুধু ডাক্তারি পড়ার জন্য আমি কাবুলে খাতিম-উল-নবিইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি একটি বিউটি ক্লিনিকেও কাজ করতাম। আমার কাজকে আমি ভালোবাসতাম। আমি আমার সাফল্য ও স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তেই ছিলাম; কিন্তু দুঃখজনকভাবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গেল। যে ভীত মুখগুলোকে আমি দেখেছি, বা যে ধরনের ভয়ানক পরিস্থিতি আমি দেখেছি, তা কেবল ভৌতিক সিনেমাতেই দেখেছি এবং দুঃখের গল্পগুলোতেই পড়েছি। আজ আমার স্বপ্নগুলো ধূলিসাৎ হওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যা কখনো হওয়ার কথা ছিল না। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম নিজ দেশে আমার স্বপ্ন পূরণের, আর সেই নিজ দেশেই আজ আমার সব স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সুত্রঃ প্রথম আলো
3 comments
আফগান নারীদের জন্য দুঃখজনক ঘটনা যে তারা নারী হিসাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত
আফগানে নারী ওপর নানা ধরনের হয়রানিমূলক আক্রমণ বেড়ে গেছে।
প্রতিটি শিক্ষিত নারী আফগানিস্তানে আজ মানবেতর জীবন যাপন করছে দেখার কেউ নেই