তাঁর জন্ম ঢাকায়। বড় হয়েছেন এই শহরে, পড়ালেখাও এখানে। এই মহানগরের অলিগলি তাঁর অতি আপন। তাই নিজেকে কখনও অনিরাপদ ভাবেননি তিনি। তবে গত বুধবার গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পর থেকে তাঁর সেই বিশ্বাস ভেঙে গেছে।
ওই রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শিউরে ওঠেন একটি রেডিও স্টেশনের ‘ভয়েস আর্টিস্ট’ হিসেবে কর্মরত ওই তরুণী। বললেন, ‘হাতটি আমার শরীরে খামচে ধরার আগ পর্যন্ত টের পাইনি। হঠাৎ খামচে ধরায় ভয়ে আঁতকে উঠি। ওই সড়কে লোকজন ছিল। কিন্তু কেউ আমার চিৎকারে এগিয়ে আসেনি। সহায়তা পাইনি কারও কাছ থেকে। যেন সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।’
নিপীড়নের শিকার তরুণী শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে আসামি অজ্ঞাত একজন মোটরসাইকেল আরোহী। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যায়নি। আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তরুণীকে দূর থেকে মোটরসাইকেল আরোহী অনুসরণ করেছিল কিনা তা বুঝতে তিনি যে সড়ক হয়ে রিকশায় এসেছিলেন সেসব এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হবে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে ওই তরুণীর সঙ্গে কথা হয় সমকালের। তিনি জানান, ব্যক্তিগত কাজে বুধবার বিকেলে তিনি পুরান ঢাকার বাসা থেকে ধানমন্ডিতে এক স্বজনের বাসায় যান। সেখান থেকে আনুমানিক রাত পৌনে ১২টার দিকে একটি রিকশায় বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। রিকশা চালকের বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি হতে পারে। রিকশাটি জিগাতলা-সায়েন্স ল্যাবরেটরি-নিউমার্কেট হয়ে ঢাবি এলাকায় ঢোকে রাত সোয়া ১২টায়। তিনি কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে গান শুনছিলেন। কানে হেডফোন থাকায় কখন যে তার বাম পাশে একটি মোটরসাইকেল আরোহী এসে থেমেছে তা টের পাননি।
তিনি বলেন, ‘রিকশার বাম পাশ থেকে হঠাৎ একটি হাত খামচে ধরে আমাকে। তখন তাকিয়ে দেখি ঢাবির এ এফ রহমান হল পার হয়ে রিকশাটি একটু সামনে এসেছে। ওই ব্যক্তি বাম হাত দিয়ে চলন্ত মোটরসাইকেল ধরে ডান হাত দিয়ে আমাকে খামচে ধরেছিল।’ তিনি জানান, এ সময় তিনি চিৎকার করেন নিপীড়ককে ধরার জন্য। নিপীড়ক ডান হাত উঁচিয়ে চোখ রাঙিয়ে গালাগাল করতে করতে মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে সামনের দিকে চলে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি।
তিনি বলেন, কেউ যখন চিৎকার শুনেও এগিয়ে এলো না, তখন রিকশাওয়ালাকেই ওই নিপীড়ককে ধরতে বলি। তিনি বয়স্ক মানুষ। সাহস করেননি। রিকশাওয়ালা আমাকে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী আমার পূর্বপরিচিত। এ ঘটনার পর আমি বাসা পর্যন্ত যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। রিকশাওয়ালা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। বাসায় পৌঁছেও কাঁপছিলাম। ঘটনাটি আব্বু-আম্মুকে জানাই।’
এরপর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিজেই ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। জামার ছেঁড়া অংশের ছবি দিয়ে লেখেন, ‘এই যে আমার ছেঁড়া জামাটা। আমার সাথে কেনো এমনটা হলো? কখনও ভাবিনি আমার ঢাকা শহরে আমার সাথেই এমন কিছু হতে পারে।’ ওই স্ট্যাটাস ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তরুণী জানান, তিনি নিপীড়ককে দেখলে চিনতে পারবেন। সে সময় তার মাথায় হেলমেট থাকলেও সামনের গ্লাস খোলা ছিল। আশপাশে আলো থাকায় মুখটি তাঁর কাছে স্পষ্ট। গায়ের রং শ্যামলা বর্ণের এবং মুখমণ্ডল গোলাকার।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তায় একজন মেয়ে একা চলতে পারবে না- এটা কী হতে পারে? ভয় নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে? নিপীড়ককে শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করা জরুরি। না হলে তাঁর মতো আরও কোনো নারী নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। এ কারণেই তিনি বিষয়টি নিয়ে থানা পুলিশ পর্যন্ত গেছেন।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অন্য নারীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এই তরুণী। বলেন, ‘আমার একটাই চাওয়া- নারীরা সবাই আমার মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। ভয়ে কিংবা অন্যরা কী ভাববে কী বলবে- এসব না ভেবে নিজের সঙ্গে ঘটা অন্যায়গুলো নিয়ে ভাবতে শিখুক। রাস্তায় স্বাধীনভাবে চলতে হলে আওয়াজ তুলতেই হবে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে।’ রাজধানীতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময় ছাত্র আন্দোলনসহ নানা সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
প্রতিবাদ: এ নিপীড়নের ঘটনায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ওই তরুণীর নিগৃহীত হওয়া খুবই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। নিপীড়ককে দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
সুত্রঃ সমকাল