দেশের ১১৪টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। কর্তৃপক্ষের অনীহা ও দায়িত্বহীনতার কারণে নিষ্ক্রিয় এসব কমিটি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও এ বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীরা কোথায় অভিযোগ জানাবে সে বিষয়েও ধারণা থাকে না। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় এ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে জানা গেছে, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। এরপরও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) কমিটি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি থাকলেও তা পাঁচ বছর ধরে অকার্যকর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটির কার্যকারিতা নেই। রাজশাহী ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি থাকলেও এর কার্যক্রম সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছুই জানেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) কমিটি সক্রিয়।
অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইস্টওয়েস্ট, ইউনির্ভাসিটি অব লিবারেল আর্টস, সেন্টার অব উইমেন্স, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নিয়মিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে।
ইউজিসিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জনান, দেশের ৫২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪২টিতে কমিটি আছে, ১০টিতে নেই। কমিটি নেই বুয়েট, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসিকে কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে। কিন্তু ওই কমিটির কোনো বিবরণ দেয়নি। এর বাইরে নতুন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। দেশের ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৭২টিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ইউজিসির যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলের উপ-পরিচালক মৌলি আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ২০০৯ সালের ১৪ মে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কয়েকটি দিকনির্দেশনাসহ রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কেন্দ্র এবং তা পরিচালনার জন্য ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী। বাকি চার সদস্যের মধ্যে একাধিক নারী সদস্য থাকবেন।
এরপর ইউজিসি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। মূলত তারপরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কেন্দ্র গঠন করতে আমরা চিঠি পাঠাই।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হলেও তাদের কোনো প্রচারণা ও কার্যকারিতা নেই। এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউএন উইমেনের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব অভিযোগ আসবে তারা সেটি খতিয়ে দেখে আমাদের কাছে প্রতিবেদন দেবে। তার ভিত্তিতে ইউজিসি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে অধিকাংশই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে না।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তিনজন শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন, রবি বা সোমবারের মধ্যেই তাদের বহিষ্কার করা হবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রসহ চারজনকে আটক করেছে র্যাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, এ ঘটনার পরই ইউজিসির একজন সদস্য চবিতে সরেজমিনে পরিস্থিতি পরিদর্শনে গেছেন। সেখানে মূলত কী হয়েছি, কারা জড়িত, কী কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখে ইউজিসিতে প্রতিবেদন দেবেন। এরপর আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো।
তিনি বলেন, চবির মূল ক্যাম্পাসে অনেক স্থানে নিরাপত্তা প্রাচীর নেই বলে অবাধে বহিরাগতরা প্রবেশ করতে পারছে। এটি দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের হলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি। তার ওপরে ইউজিসি থেকে যৌন নিপীড়ন বন্ধে কমিটি গঠন করতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারা তা করেনি। অনেকে আবার নামমাত্র কমিটি গঠন করলেও তার কোনো কার্যকারিতা নেই। সে কারণে আরেক দফায় সব বিশ্ববিদ্যালয়কে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক কমিটি গঠন করে নিয়মিত কার্যক্রম ও প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হবে।
সুত্রঃ জাগো নিউজ