ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে কুড়িগ্রামের ফেলানী খাতুন নিহতের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও ন্যায়বিচার আসেনি বলে অভিযোগ করেছে পরিবার।
ফেলানীর বাবা-মা বলেন, তারা ন্যায়বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছেন।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিয়ের উদ্দেশে ভারত থেকে বাবার সঙ্গে দেশে ফেরার পথে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানী। ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে চার ঘণ্টার বেশি সময় ঝুলে ছিল। মর্মস্পর্শী এই দৃশ্য তখন সারাবিশ্বেই সমালোচনা তৈরি করে।
সেদিনের কথা স্মরণ করে ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, “আমাদের নিরস্ত্র সন্তানকে নির্মমভাবে কাঁটাতারে হত্যা করা হয়েছে। তাকে একটু পানিও খেতে দেওয়া হয়নি।”
ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছি। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আমরা না পেলাম ক্ষতিপূরণ, না পেলাম ন্যায়বিচার।”
ফেলানী হত্যা: ন্যায়বিচারের আশায় বাবা-মায়ের এক যুগ
ফেলানীর বাবা-মা দুজনই এ ঘটনার আসামি ও বিএসএফের সদস্য অমিয় ঘোষের ফাঁসি দাবি করেন।
ওই এলাকার বাসিন্দা মজিরণ ও সামসুল জানান, প্রথম প্রথম লোকজন খোঁজখবর নিলেও এখন আর কেউ এই পরিবারের খোঁজ-খবর রাখে না। বিচার শুরুর সময় মনে হয়েছিল, পরিবারটি ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু যেভাবে বিচার হচ্ছে এবং সময় যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার পাবে না পরিবার।
সীমান্তের কাছের এই দুই বাসিন্দা আরও অভিযোগ করেন, ফেলানী হত্যার এক যুগেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন।
এ মামলায় সহায়তাকারী হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী ও কুড়িগ্রাম জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলী (পিপি) এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, “করোনার কারণে ফেলানী খাতুন হত্যার বিচার ঝুলে আছে। দুই রাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখতে ভারতের উচ্চ আদালত বিচারটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।“
নূর ইসলাম পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতের আসাম রাজ্যের বোয়াইলপাড়া জেলার বঙ্গাইগাও এলাকায়। তিনি সেখানে ইটভাটায় কাজ করতেন। ২০১১ সালে কিশোরী ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয় বাংলাদেশে। বিয়ের উদ্দেশে বাবার সঙ্গে দেশে ফিরছিল ফেলানী।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ীর উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে বাবা নুর ইসলামের সঙ্গে মই দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া টপকিয়ে বাংলাদেশে ফেলার সময় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ফেলানী। নুর ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেমে রক্ষা পান। ফেলানীর নিথর দেহ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল। এ হত্যাকাণ্ডে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার কর্মীদের মাঝে সমালোচনার ঝড় উঠলে ২০১৩ সালের ১৩ অগাস্ট কোচবিহারে বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচারকাজ শুরু হয়। সেখানে ফেলানীর বাবা ও মামা হানিফ সাক্ষ্য দেন।
২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাদ দেয় ভারতের কোচবিহারের সোনারী ছাউনিতে স্থাপিত বিএসএফের বিশেষ আদালত। পুনঃবিচারের দাবিতে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের নিকট আবেদন করেন। পরে বিজিবি-বিএসএফের দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে ফেলানী হত্যার পুনঃবিচারের সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু করে বিএসএফ। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম বিএসএফের বিশেষ আদালতে অমিয় ঘোষকে অভিযুক্ত করে পুনরায় সাক্ষ্য প্রদান করেন এবং অমিয় ঘোষের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। ২০১৫ সালের ২ জুলাই এ আদালতে অমিয় ঘোষ আবারও বেকসুর খালাস পান।
২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতীয় ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ (মাসুম) ফেলানী খাতুন হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করে। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর শুনানীর পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে বারবার তারিখ পিছিয়ে যায়।
২০২০ সালের ১৮ মার্চ করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপ শুরুর আগে শুনানির দিন ধার্য হলেও তা আর হয়নি। ফলে থমকে যায় ফেলানী খাতুন হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি।
সুত্রঃ