রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য (ডোনার) খন্দকার মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, তিনি অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর বন্ধু। বন্ধুত্বের কারণে মুশতাকের বাড়িতে শিক্ষা সফরে ছাত্রীদের নিয়ে যান ফাওজিয়া। সেখানেই ভিকটিমের সঙ্গে অভিযুক্তের পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্র ধরে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেন তিনি। এই ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে দাবি করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে অভিভাবক ফোরাম।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রোস্তম আলী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের দাতা সদস্য ষাটোর্ধ্ব খন্দকার মুশতাক আহমেদ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার ১৭ বছর বয়সী ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রেখেছেন। একপর্যায়ে অভিভাবকদের চাপে সম্প্রতি তৃতীয় বিয়ে করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উত্তেজনা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, শিক্ষা সফরের নামে গত ১৮ মার্চ খন্দকার মুশতাক আহমেদের নরসিংদীর বাড়িতে ছাত্রীদের নিয়ে যান কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী। এদিনের একটি ভিডিও সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর অভিযোগ ওঠে, শিক্ষা সফরে এক ছাত্রীকে ‘লোভ’ দেখিয়ে সখ্য তৈরি করেন মুশতাক। বিষয়টি শিক্ষক ও অন্যান্য ছাত্রীদের নজরে আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বলেন, মুশতাককে গলায় মালা পরান এবং মুখে তুলে খাওয়ান কলেজের অধ্যক্ষ। অনুষ্ঠানের ছবিতেই এটা দেখা যাচ্ছে। অধ্যক্ষের ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ার কারণে শিক্ষা সফর করা হয়েছে তার বাড়িতে।
অভিভাবক ঐক্য ফেরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে আগেও ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আগে সঠিক বিচার হলে নতুন করে এমন ঘটনা ঘটতো না।
যা বলছেন অভিযুক্ত
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খন্দকার মুশতাক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই মেয়ের সঙ্গে আমার এ ধরনের কোনও সস্পর্ক থাকতে পারে না। অভিভাবকদের চাপে আমি বিয়ে করেছি এ্টা অভিযোগ করা হয়েছে। এতো ছোট মেয়েকে কীভাবে বিয়ে করি? ’
অধ্যক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে সমলোচনার জাবাবে খন্দকার মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘উনি বয়স্ক মহিলা আমিও বয়স্ক মানুষ। কী আর বলবো। তার সঙ্গে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছি। তার স্বামীও আমার সহপাঠী।’
তদন্ত কমিটি কেন গঠন করা হলো– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি পূর্বপরিকল্পিত। একটি ঘটনা যখন ঘটেছে তখন তদন্ত যদি না করে তাহলে আমাকে ফেভার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠবে। মেয়ে বা তার পরিবার থেকে কোনও অভিযোগ করা হয়নি। তদন্ত হোক, আমার কোন অপত্তি নেই।’
গভর্নিং বডির আরও এক সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ভিডিও ভাইরালের পর গভর্নিং বডির আরেক অভিভাবক সদস্য (প্রাথমিক) মো. শাহাদাৎ হোসেন ঢালীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও অভিভাবকরা গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, শাহাদাৎ ঢালীর ‘সেইফ কোচিং সেন্টারে’ অসামাজিক কার্যকলাপ করা হয়। এছাড়া ঢালী নির্মাণ কমিটির সদস্য। নিজে নির্মাণকাজ করে অন্যের নামে বিল সাবমিট করেন। নিজেই বিল তৈরি করেন। একই বিল বার বার তৈরি করেন। ২০২২ সালে ১০ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে ভর্তিপ্রতি ছয় লাখ করে টাকা নিয়েছেন। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। অধ্যক্ষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে এমন আচরণ করার সাহস পাচ্ছেন ঢালী।
অভিযোগের বিষয়ে মো. শাহাদাৎ হোসেন ঢালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করেছি। সে কারণে হঠাৎ করে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। দেড় বছর আগে প্রধান শিক্ষকের (স্কুল শাখার) সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে অধ্যক্ষের উপস্থিতিতে। কোনও অভিযোগ না পেয়ে আমার বিরুদ্ধে এইগুলো করা করছে।’
অধ্যক্ষের সঙ্গে সখ্য সম্পর্কে ঢালী বলেন, ‘অধ্যক্ষ নামাজ পড়েন। আমি তাকে কোনও খারাপ কাজ করতে দেখিনি।’
শিক্ষা সফর গভর্নিং বডির সদস্যের বাড়িতে কেনও করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খন্দকার মোশতাকের বাড়ি একটি পিকনিক স্পট। তবে তিনি যেটা করছেন তা ঠিক কাজ করেননি। যদি আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণ হয় আমি পদত্যাগ করবো। যা শাস্তি হয় মাথা পেতে নেবো।’
তদন্ত কমিটি
ছাত্রীকে যৌননির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নিং বডির অভিভাবক সদস্য (উচ্চমাধ্যমিক) গোলাম আশরাফ তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটি ভিডিও এসেছে খন্দকার মুশতাকের। সেটা একটি গাড়ির মধ্যে। মেয়ে বা মেয়ের অভিভাবক কোনও অভিযোগ করেনি। তবে বেনামে কয়েকটি চিঠি আসায় গভর্নিং বডি সেটা তদন্ত করেছে। দ্বিতীয় ভিডিও নিয়ে অভিযোগ আছে সেটি আমি দেখিনি।’
ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘মিটিংয়ে এজেন্ডাভুক্ত করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গভর্নিং বডি নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে গভর্নিং বডির সদস্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ না থেকে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত চলাকালে মুশতাক কমিটির কার্যক্রমে নিজে থেকেই থাকবেন না বলে জানিয়েছেন।’
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যে মুহূর্তে জানতে পেরেছি একটি ঘটনা হয়েছে, তখন এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে চিঠি ইস্যু করেছি। তিনি আগামী সাত কর্মদিসের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট দেবেন। ‘
বন্ধুত্বের সুযোগে খন্দকার মুশতাক আহমেদ এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। বন্ধু মানে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। আমি আমার হাসব্যান্ড এবং খন্দকার মুশতাক আমরা সহপাঠী ছিলাম। কে কী বললো তাতে আমার কিছু আসে যায় না।’
ঢালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, ‘এখন বেনামে অভিযোগ দেওয়া তো একটি কালচার হয়ে গেছে। কাল একটা অভিযোগ পেয়েছি।’
গভর্নিং বডির সদস্যের বাড়িতে শিক্ষা সফর কেন করা হলো, ছাত্রীদের সঙ্গে খন্দকার মুশতাকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেননি অধ্যক্ষ।