গত কয়েক বছরে সরাসরি জঙ্গি হামলার কোনও ঘটনা ঘটেনি দেশে। একমাত্র জামাতুল আনসারের পাহাড়ি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছাড়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য কোনও তৎপরতা নেই। তবে অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে সবগুলো জঙ্গি সংগঠন। নীরবে সদস্য সংগ্রহ করছে তারা। বাড়াচ্ছে সাংগঠনিক শক্তি। সংশিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা যেকোনও সময় হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে হামলার পরিকল্পনাও করছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের জোট বেঁধে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির তথ্যও পেয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জঙ্গি প্রতিরোধে গঠিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। একে একে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে নিহত হয় একাধিক শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই। এরপর নব্য জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের পর থেকে জঙ্গিরা বড় কোনও হামলার ঘটনা ঘটাতে পারেনি।
পুলিশ সদরদফতরের সূত্র বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জঙ্গিবাদ বিষয়ক ১ হাজার ৯৪৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৯ হাজার ৭২ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ বলছে, তারা চলতি বছরই ৬৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। ২০২২ সালে ১৭০ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ২১০৬ সালে আনসার আল ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তারা ১৬৪ জন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এই ইউনিটের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এস এম রুহুল আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জঙ্গিবাদ একটি মতাদর্শিক বিষয়। এটি নিয়ে কখনও তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।’
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আপাত দৃষ্টিতে প্রকাশ্যে তৎপরতা দেখা না গেলেও জঙ্গিরা গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে এখনও সরব রয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর দাওয়াতি কার্যক্রম। সদস্য সংগ্রহ ও উগ্রবাদী প্রোপাগান্ডা চলছেই। সাংগঠনিক যোগাযোগের জন্য নিত্য-নতুন এনক্রিপ্টেড অ্যাপস ব্যবহার করছে তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সরকার তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে জঙ্গি সদস্যরা। আনসার আল ইসলাম ও জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সম্প্রতি তাদের একটি সিক্রেট যোগাযোগ মাধ্যমে হামলার বিষয়ে আলোচনা করার কিছু তথ্য পেয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এরই ধারাবাহিকতায় তারা অনলাইন ও অফলাইনের সদস্য সংগ্রহ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর আলোচনায় আসা জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির কার্যক্রম একেবারে কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, সংগঠনের সর্বশেষ আমির মেহেদি হাসান জন তুরস্কে বসে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। সম্প্রতি তুরস্কের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করার পর নতুন কোনও আমিরের নাম শোনা যায়নি। বাংলাদেশে থাকা এই সংগঠনের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনের এত সদস্য গ্রেফতার করা হয়েছে যে, তাদের নতুন করে সংগঠিত হতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।
সিটিটিসির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। জঙ্গিদের অনলাইন ও অফলাইন কার্যক্রম সববসয় নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
আনসার আল ইসলাম এখনও হুমকি
অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো কোনঠাসা হয়ে পড়লেও এখনও জঙ্গিবাদের থ্রেট বা হুমকি হয়ে আছে আনসার আল ইসলাম বা আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)। আল-কায়েদার মতাদর্শী নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া দীর্ঘ দিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই সংগঠনের সব সদস্যই অধিকতর উচ্চ শিক্ষিত, স্বচ্ছল ও তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ। এ কারণে এই সংগঠনের মধ্যম সারি থেকে উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের আইনের আওতায় অনেক কঠিন। ২০১৪ সাল থেকে টার্গেট কিলিং করে আলোচনায় আসা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তথা আনসার আল ইসলামকে ২০১৭ সালের পর আর কোনও হামলা করতে দেখা যায়নি।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, এ সময়ে আনসার আল ইসলাম অনলাইনে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে সদস্য সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ তারা আদালতে হামলা চালিয়ে নিজেদের চার জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই সংগঠনের সদস্যরা যেকোনও সময় হামলা শুরু করলে তাদের ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে।
জঙ্গি নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে পুরনো জঙ্গি সংগঠন— জেএমবি, আনসার-আল ইসলাম ও হুজিবি সংগঠিত হচ্ছে, অপরদিকে এসব সংগঠনের কিছু প্রবীণ নেতা জেল থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছোট ছোট দল গঠন করে দাওয়াতি কাজ চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নতুন নাম দিয়ে গোপনে তরুণদের সক্রিয় করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সদস্য সংগ্রেহর পর জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শ্বারকিয়া নামে একটি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেছিল শামীন মাহফুজ নামে এক পুরনো জঙ্গি। জেলে বসে হুজিবির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সংগঠন যাত্রা শুরু করে। এরইমধ্যে র্যাব ও পুলিশের পৃথক অভিযানে এই সংগঠনের পাহাড়ি জঙ্গি ক্যাম্প গুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন