রাজধানীর তুরাগের বাউনিয়া আদর্শপাড়ায় স্বামীর সঙ্গে থাকতেন ৩০ বছর বয়সী মুক্তা। তবে গত ৩-৪ মাস খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন না তাঁর স্বামী। তাই স্বাবলম্বী হতে নিজেই চাকরি খুঁজছিলেন। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকভাবে চাকরির বিষয়টি চূড়ান্তও হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ জুন রাতে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় মুক্তাকে। ধর্ষণ শেষে মুখের বাম পাশ হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে দেয় বাড়ির কেয়ারটেকার আলাল উদ্দিন। আলামত নষ্ট করতে পুরো শরীরে গরম পানি ঢেলে দেয় সে।
মুক্তার ভাই মোহাম্মদ মাহফুজ বলেন, ‘তিন ভাইয়ের একটাই বোন ছিল। আমাদের আদরের বোনটাকে কতটা ভয়াবহভাবে হত্যা করেছে আলাল! ঘরের দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত দেখে বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ারা পুলিশে খবর দেন।’
গত ৪ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়ায় ছয় বছরের এক কন্যাশিশুকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে বাড়ির পাশে নিয়ে যায় আব্দুল কাদের নামে এক পোশাক শ্রমিক। সেখানেই ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় শিশুটিকে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে নির্যাতনের ভয়াবহতা। ধর্ষণের পর হত্যার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন বীভৎস পন্থা অনুসরণ করছে অপরাধীরা।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, দেশে নির্যাতনের অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যায়। যেসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ও তার পরিবার আইনের আশ্রয় নেয়, সেখানেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। এ ছাড়া পেশিশক্তি ও আর্থিক কারণে অনেক আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
গত ছয় মাসে শারীরিক-মানসিকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫২০ নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ২২৩ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২৬ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২১ কন্যাশিশুকে। এ পরিসংখ্যান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের।
শুধু সদ্যসমাপ্ত জুনে ২৬৫ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৩ জন কন্যাসহ ৫৩ জন। ৫ কন্যাসহ ১৩ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৮ হাজার ৭৯২ নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৯ হাজার ৮৫০ জন।
মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী ও কন্যাশিশুর ওপর প্রতিদিন একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ব্যাপারে যতই সরব, ঠিক উল্টো চিত্র পাওয়া যায় প্রশাসনের ক্ষেত্রে।
‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’-এর আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন জানান, এ ধরনের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমার আইন থাকলেও তা মানা হয় না। এমনকি অনেক পাবলিক প্রসিকিউটর ভিকটিম ও সাক্ষীকে মামলার তারিখে আদালতে হাজির করানোর ব্যাপারেও ঔদাসীন্য দেখান। থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। ফলে ভুক্তভোগী নারী এবং কন্যাশিশুর পরিবারের চাপেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। ফলে বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের মতে, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আসার সংখ্যা কমে গেছে। এ কারণে নারীদের প্রতি নির্যাতন বাড়লেও তা বিভিন্ন সংগঠনের সংগ্রহ করা পরিসংখ্যানে যথাযথভাবে উঠে আসছে না। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি বলেন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবারে এবং অনলাইনে নারী নির্যাতন বেড়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছরই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। অনলাইনেও সহিংসতা পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, অপরাধীরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে অনলাইন মাধ্যমে সহজেই নারীদের তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তাদের নানাভাবে হয়রানি করে। নারীদের নামে ভুয়া আইডি খুলে এবং তাদের আইডি হ্যাক করে ব্ল্যাকমেলিং করার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে হয়রানি ও আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২২’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হচ্ছেন। সংগঠনটির সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বলেন, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে মানসিক হয়রানি।
অধিকার কর্মীরা বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ সত্ত্বেও এখনও নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু সমকালকে বলেন, যথাযথ আইনের অভাবে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান ও সহিংসতার শিকার নারীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তাই আইন সংস্কার জরুরি। সরকারের উদ্যোগ দেশে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, যৌতুক নিরোধ আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অনেক আইন রয়েছে। এ ছাড়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, সুরক্ষা ও সেবা প্রদানের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ক্রাইসিস সেল, ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার ও রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের মাধ্যমে মনোসামাজিক সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ টোল ফ্রি ন্যাশনাল হটলাইন ১০৯ সচল থাকে ২৪ ঘণ্টাই ।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা-নারীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম প্রতিবন্ধক। নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন মেশিনারিজ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, জনপ্রতিনিধি, কমিউনিটি লিডার ও গণমাধ্যম ঐক্যবদ্ধ হয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হবে। নারীর প্রতি এ সহিংসতা রোধে নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরাতন আইন পর্যালোচনা করতে হবে। সহিংসতার শিকার নারীকে আইনিসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে।
সুত্রঃ দৈনিক সমকাল