আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার মনিটরিং ও অব্যাহত অভিযানের কারণে জঙ্গিরা এখন আর আগের মতো সংগঠিত হতে পারছে না। এমনকি সংঘবদ্ধ কোনও হামলা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর মতো সক্ষমতাও তাদের নেই। গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সের তালিকায় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। যদিও অনলাইন মাধ্যমে এখনও তারা সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে জঙ্গিরা সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্নভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সিটিটিসি’র সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলাম ও হিজবুত তাহরীর, নিউ জেএমবির অনলাইন কর্মকাণ্ড নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম থেকে গঠিত জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নেতাদের সম্প্রতি গ্রেফতারের পর সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্র বলছে, পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, জঙ্গি সদস্যরা বর্তমানে অনলাইনে তৎপর রয়েছে। ৮২ ভাগ জঙ্গি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে র্যাডিকালাইজেশনের জন্য টার্গেট সংগ্রহ করছে। আর এসব টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সি তরুণরাই জঙ্গি সংগঠনগুলোর বেশি টার্গেট হয়ে থাকে। এই বয়সী তরুণ-তরুণীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে বেশি।
বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে ৫১২ জন জঙ্গির তথ্যভাণ্ডার রয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে। যাদের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকাসহ তাদের যোগাযোগ থাকা ব্যক্তিদের বিষয়েও তথ্য রয়েছে। যা প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। সিটিটিসি’র গবেষণা তথ্য বলছে, যখনই জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করা হয়— একইসঙ্গে ওই জঙ্গির সামাজিক অবস্থান, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণাদিসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পর সময়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সময় গ্রেফতারকৃত জঙ্গি সম্পর্কে আদালতকে সুস্পষ্ট পরিচয়, ঠিকানা এবং বিভিন্ন বিষয় অবহিত করা হয়। বিভিন্ন সময় ৩৪টি গবেষণার ভিত্তিতে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে সিটিটিসি। জঙ্গিদের নিয়ে সংস্থাটির আরও ১০টি গবেষণা চলমান রয়েছে।
সিটিটিসি’র তথ্য বলছে, বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃত ৫১২ জঙ্গির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৬৮.৭ ভাগ জঙ্গির বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে আবার ২৭.৫ ভাগের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছর। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ২০.১ ভাগ, ৩০ থেকে ৩৪ বছর বয়সি ১৩.৫ ভাগ, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৭.৬ ভাগ। জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের রয়েছে ২৩ ভাগ এবং সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ৭৪ ভাগ।
সিটিটিসি’র গবেষণা বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৫১২ জঙ্গির তথ্য পর্যালোচনায় পাওয়া জঙ্গিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষিতদের মধ্যে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার হার ১৯.৫ ভাগ। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ১৩.১০ ভাগ। এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২০.৭০ ভাগ। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ৩০.৮০ ভাগ এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে জঙ্গিবাদের জড়িয়ে পড়ার হার ১৫ ভাগ।
গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সের তালিকায় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বেশ কয়েক বছরের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে জঙ্গিবাদের ঘটনা বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২২, ২০১৭ সালে ২১, ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ৩১, ২০২০ সালে ৩৩, ২০২২ সালে ৪০, ২০২৩ সালে ৪৩ তম অবস্থানে রয়েছে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে উগ্রবাদ কিংবা জঙ্গিবাদের সমস্যা যেমন আমাদের দেশকে প্রভাবিত করে, তেমিই এদেশের কোনও ঘটনা সারা বিশ্বে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গুলশানের হলি আর্টিজনের হামলার ঘটনার পর বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ দমনে বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমনে আগে হার্ড অ্যাপ্রোচ অপারেশনাল পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে সফট অ্যাপ্রোচের মাধ্যমেও সিটিটিসি কাজ করছে। আমরা যদি সন্ত্রাসবাদ দমন করতে চাই, তাহলে সন্ত্রাসবাদ উত্থানের উপাদান, সেগুলো নির্মূল করতে হবে। তাহলে আমাদের সমাজে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। তবে এত কিছুর পরেও আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। সব দিকেই নজর রাখা হচ্ছে।’
কমেছে জঙ্গি হামলার ঘটনা
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে জানায়, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং জনসম্পৃক্ততার কারণে জঙ্গি তৎপরতা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। তবে ২০১৫-১৬ সালে দেশে জঙ্গিবাদ যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, ২০২২ সালে এসে দেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা থেমে যায়। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে দেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫০টি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১টি হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে।
সিটিটিসি বলছে, ২০২২ সালে দেশে কোনও জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। ২০২১ সালে জঙ্গি হামলা হয়েছিল একটি। ২০২০ সালে দুটি, ২০১৯ সালে ছয়টি, ২০১৮ সালে দুইটি, ২০১৭ সালে তিনটি, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ২১টি, ২০১৫ সালে ১৫টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে।
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন