রাজিয়া সুলতানাছবি: সংগৃহীত
ঢাকা মেডিকেলের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক মোখলেসুর রহমান আশির দশকে তাঁর মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের ছোটবেলায় দেখা একটা গল্প বলতেন। গ্রামের বয়স্ক লোকজনের আড্ডায় একবার খবর এল, গ্রামের এক কিশোরী মা রহিমা মারা গেছে। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন, কীভাবে রহিমা গেল। খবরদাতা বললেন, ‘বাচ্চা হতে গিয়ে।’ সেটা শুনে সবাই আশ্বস্ত হলেন যে ‘অস্বাভাবিক’ কোনো মৃত্যু নয়। ওই সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এত বেশিসংখ্যক মায়ের মৃত্যু হতো যে সেটাকে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনাই মনে করা হতো।
এখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে। মাতৃমৃত্যুর যেসব ঝুঁকি রয়েছে, তার বেশির ভাগকে এখন প্রতিরোধযোগ্য মনে করা হয়। এই সময়ে বাড়িতে সন্তান প্রসবের পর সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া সুলতানার (২১) মৃত্যু মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য বড় একটি ধাক্কা। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাড়িতে প্রসবের ঝুঁকি এবং অন্তঃসত্ত্বা মায়ের প্রতি অবহেলা ও অসচেতনতার চিত্র ফুটে ওঠে। পাশাপাশি হাসপাতালে প্রসবে উৎসাহী করতে সরকারি উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়টি সামনে এসেছে।
রাজিয়া সুলতানা ২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীনাথপুরে নিজ বাড়িতে ধাত্রীর সহযোগিতায় সন্তানের জন্ম দেন রাজিয়া সুলতানা। এর কয়েক ঘণ্টা পর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২ অনুসারে, দেশে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান গড়ে ১৫৩ জন মা। গ্রামে এ হার ১৫৭ এবং শহরে ১৩৫। গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে মৃত্যুকে ‘মাতৃমৃত্যু’ বলা হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, এখনো বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার ৪২ শতাংশের বেশি।
রক্তক্ষরণে মৃত্যু বেশি
অধ্যাপক মোখলেসুর রহমানের বলা গল্পটি তাঁর ছাত্রী অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগমের কাছ থেকে শোনা। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, রাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে চরম অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছিল ফুটবলার রাজিয়া সুলতানাকে। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জ্যোতির্ময় প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই রাজিয়ার মৃত্যু হয়। ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ (বিএমএসএস) ২০১৬ অনুসারে, মাতৃমৃত্যুর ৩৯ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে। এর মধ্যে গর্ভকালে প্রায় ১৮ শতাংশ এবং প্রসব–পরবর্তী সময়ে ২১ শতাংশের বেশি মাতৃমৃত্যু হয়।
বিবিএসের প্রতিবেদনটিতে প্রসবকালে জটিলতা, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, গর্ভকালে রক্তক্ষরণ, জটিল গর্ভপাত, গর্ভধারণে জটিলতা, ধনুষ্টংকার ও বিলম্বিত প্রসবে মৃত্যু—এই সাত কারণে মাতৃমৃত্যু হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখন কমলেও এখনো সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই হয় বলে জানালেন ফেরদৌসী বেগম। তিনি বলেন, গর্ভফুল জরায়ুর গায়ে লাগানো থাকে। কোনো কারণে গর্ভফুল জরায়ুর গা থেকে আলগা হয়ে গেলে বা জরায়ুতে শিশু ওপরে ও গর্ভফুল নিচে চলে এলে প্রসবকালে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রক্তক্ষরণে মৃত্যুর বেশির ভাগ ঘটে প্রসব–পরবর্তী সময়ে। যার প্রধান কারণ প্রসবের পরে জরায়ু সংকুচিত না হাওয়া; এ ছাড়া জরায়ু বা প্রসবপথ ছিঁড়ে যাওয়া, গর্ভফুল বা তার অংশ জরায়ুতে থেকে যাওয়া, রক্ত জমাট বাঁধতে না পারার কারণেও প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ হতে পারে।
গর্ভধারণ যেকোনো সময় জটিল হতে পারে
নিয়মিত গর্ভকালীন চিকিৎসাসেবার গুরুত্ব তুলে ধরে এই চিকিৎসক বলেন, যিনি মনে করছেন যে তিনি শারীরিকভাবে খুব সক্ষম, সুস্থ, তাঁর প্রসবের সময় কোনো জটিলতা হবে না—এটা একেবারে ভুল ধারণা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণের তুলনায় স্বল্প ঝুঁকির গর্ভধারণের ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যু বেশি হয়েছে। কারণ, একাধিক সন্তান জন্ম দিয়েছেন এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে, এমন মায়েরা ঝুঁকিতে আছেন জেনে নিয়মিত প্রসব–পূর্ব সেবা নিয়েছেন ও হাসপাতালে প্রসব করেছেন। অন্যদিকে কম বয়সী, প্রথম গর্ভধারণ করা মা বা কোনো ঝুঁকি নেই এমন মা প্রসব–পূর্ব সেবা না নেওয়ায় বাড়িতে প্রসব করে জটিলতায় ভুগেছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন। গর্ভধারণ স্বাভাবিক বিষয় হলেও এটা যেকোনো সময় জটিল হয়ে উঠতে পারে।
রাজিয়ার মা আবিরণ বিবি জানিয়েছেন, অন্তঃসত্ত্বা থাকতে এক পরিবার পরিকল্পনা কর্মী রাজিয়া সুলতানাকে ডেকে একটি ইনজেকশন দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তেমন কোনো চিকিৎসা নেওয়া হয়নি।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের গাইনি বিভাগের সহকারী সার্জন ফারজানা মাহমুদ বলেন, হাসপাতালে প্রসব হলে যেকোনো জটিলতায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। স্বাভাবিক প্রসবের পর ৫০০ মিলিলিটারের বেশি রক্তক্ষরণ হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হয়। দ্রুত হাসপাতালে এলে এবং ব্যবস্থা নিতে পারলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে মা সুস্থ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালে আনার পাশাপাশি মায়ের রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী রক্তদাতা তৈরি রাখতে হবে।
সেবা নেওয়ার হার কম
গর্ভকালীন সেবা কমপক্ষে চারবার নেওয়ার কথা বলা হলেও দেশে এ হার অনেক কম। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, চারবার ও এর বেশিবার গর্ভকালীন সেবা নেওয়ার হার আগের চেয়ে ৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪১ শতাংশে। এ ছাড়া ভালো মানের গর্ভকালীন সেবা নেওয়ার হার মাত্র ২১ শতাংশ। এখানে ‘ভালো মান’ বলতে বলা হয়েছে, চারবার সেবা নেওয়ার মধ্যে অন্তত একবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া; ওজন ও রক্তচাপ মাপা; রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করা এবং গর্ভকালে সম্ভাব্য বিপজ্জনক লক্ষণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া।
ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় ৩ হাজার ৩৬৪ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। তবে সেখানে কোনো চিকিৎসকের পদ নেই। ফলে ভালো মানের প্রসবসেবা নিতে হলে উপজেলা সদরে আসতে হয় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের।
অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, সরকার, দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা—সবার মাতৃস্বাস্থ্যের প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া উচিত, আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার। জনবলের ঘাটতি আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও কম। দুর্নীতিও বড় সমস্যা। অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই, যন্ত্রপাতি নেই, বাজেট বরাদ্দ কম, বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না, ব্লাড ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে। মায়ের জীবন বাঁচাতে অক্সিটোসিন, মিসোপ্রস্টল, ট্র্যানেক্সামিক অ্যাসিড, কারবেটোসিনের সরবরাহ ও মজুত নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. মনজুর হোসেন বলেন, অনেক পরিবার এখনো বাড়িতে প্রসব করাচ্ছে, গর্ভকালীন সেবা নিচ্ছে না, এটা দুঃখজনক। সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক অনেক বার্তা প্রচার করা হয়। এরপরও অনেকে সচেতন হচ্ছেন না। সন্তান প্রসবের পর রক্তক্ষরণ ঠেকাতে হাসপাতালে মিসোপ্রস্টল মজুত রাখা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
সুত্রঃ প্রথম আলো