নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যেই নিষ্পত্তি, ধর্ষণের শিকার নারীর চিকিৎসা খরচ রাষ্ট্রকে বহনসহ ১৩ দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় মশাল মিছিল করেছে নারীরা।
মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘নারীরা কেড়ে নাও মুক্ত আকাশ, নিরন্তর ও নিঃশঙ্ক স্বাধীনতা’ শীর্ষক সমাবেশ করেন তারা। এসময় তারা ১৩ দফা দাবি ঘোষণা করেন। সমাবেশ শেষে রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মশাল মিছিল নিয়ে ডাস চত্বর-রোকেয়া হল-ভিসি চত্বর হয়ে আবার রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ করে।
এসময় নারী শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমুর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নুজিয়া হাসিন রাশা, ঢাকার নারী সংগঠক স্কাইয়া ইসলাম, হিলস উইমেন ফেডারেশনের সদস্য রূপসী চাকমা প্রমুখ।
স্কাইয়া ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে নারীরা নিপীড়নের শিকার হলে আমরা আন্দোলনে রাজপথে নামি। কিন্তু আমাদের দেশ তিপ্পান্ন বছর আগে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু নারীদের স্বাধীনতা নেই। নারীরা কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন ও আর্থিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশে নারীদের ভূমিকা আমরা চাইলেই বাদ দিতে পারি না৷ এই জুলাইয়ের আন্দোলনেও নারীদের অবদান আমরা দেখতে পেলাম। নারীর সমান অধিকার সাংবিধানিক অধিকার হলেও আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু অভ্যুত্থানে নারীরা আরও বেশি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। নারীর ভেতরের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিলুপ্তি করা ছাড়া নারী নিপীড়ন থামানো যাবে না।
রূপসী চাকমা বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলায় তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অনেক ঘটনা আমাদের অগোচরে রয়েছে। একজন নারী হিসেবে আমি জানি, বর্তমানে একজন নারী রাস্তায় হাঁটতেও ইনসিকিউর ফিল করে।
তিনি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে হীনভাবে দেখা হয়। সেখানে নারী সবসময় ভিকটিম হয়। আমাদের সমাজের যে কাঠামো— এই কাঠামো বলে পুরুষ যা চায় তাই করতে পারবে। নাহলে একজন শিক্ষক কীভাবে ধর্ষণের সাহস পায়। নারীর অধিকার নিশ্চিত করলেই দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নারী কোনও কোনও জায়গায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেসব জায়গায় চিহ্নিত করে সেগুলো বিচার নিশ্চিত করলেই নারীর অধিকার নিশ্চিত সম্ভব।
শাহিনুর সুমি বলেন, তিপ্পান্ন বছর পরেও কেন গুম-ধর্ষণ-খুন-অমর্যাদা থাকবে? এগুলো তো থাকার কথা ছিল না। আমাদের যে সামাজিক পুঁজিবাদী কাঠামো রয়েছে, তারমধ্যে একটি ফ্যাসিস্ট মানসিকতা গড়ে উঠেছে। এখানে তারা নারীকে মানুষ হিসেবে দেখে না, নারীকে ভোগ্যপণ্য বলে মনে করে। সেই মানসিকতা থেকেই তারা ধর্ষক হয়ে ওঠে।
এসময় তিনি আরও বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে ভাঙতে হলে নারী-পুরুষ সকলকে কথা বলতে হবে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আমরা ভাঙতে না পারি তাহলে আমরা প্রত্যাশিত সমাজ গড়তে পারবো না, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না।
গত ষোলো বছর ধরে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নারী লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দাবি করে তিনি বলেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সকল ধর্ষণের ঘটনার বিচার করতে হবে। তনু-মুনিয়াসহ সকল ঘটনার বিচার করতে হবে। যদি বিচার করতে না পারে তাহলে নারী নিপীড়ন থামানো যাবে না, ধর্ষক হওয়ার মানসিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
তাদের ঘোষিত দাবিগুলো হলো— ১. বনানীতে ১ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, বান্দরবানের কিশোরীকে ধর্ষণ, ও বিগত তনু, মুনিয়াসহ প্রতিটি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। ২. ধর্ষণের ভিকটিমের চিকিৎসা খরচ রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। ৩. ধর্ষণ ও হ্যারাসমেন্টের মামলা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মীমাংসা করে ফেলার চাপ না দিতে পারে বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করতে পারে তা নিশ্চিত করত হবে। ৪. নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যেই নিষ্পত্তি করতে হবে। ৫. বিদ্যমান ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫(৪) ধারা বাতিল করতে হবে। ৬. ধর্ম, গোত্র, বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিটি লিঙ্গের মানুষের সম্পত্তিতে সমানাধিকার দিতে হবে। ৭. ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। ৮. সন্তানের অভিভাবকত্ব আইন পরিবর্তন করতে হবে। নারীকেও সন্তানের অভিভাবকত্ব দিতে হবে।
৯. ২০০৯ সালের হাইকোর্ট নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি এবং সেল তৈরি এবং কার্যকর করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি ও সেলে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে। ১০. ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৩১২ ধারায় উল্লেখিত গর্ভপাতের অধিকারবিরোধী আইন বাতিল করতে হবে। নারীকে গর্ভপাতের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
১১. প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষের রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্রে তার লৈঙ্গিক পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে। ১২. সকল প্রকার লৈঙ্গিক বৈষম্যকারী আইন বাতিল করতে হবে। ১৩. নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের মামলায় দ্রুততম সময়ে রেসপন্স করার জন্য স্পেশাল ইউনিট গঠন করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যেন ভিকটিরা কোনও ধরনের হয়রানির শিকার না হয়।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন