প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই লাইন শুরু হয়ে যেত। অ্যাভিগননের কাচ আর কংক্রিটের তৈরি কোর্টহাউসের বাইরে ব্যস্ত রিং রোডের পাশে ফুটপাথে শরতের ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতেন একদল নারী। সব সময় নারীদেরই দেখা মেলে ওই লাইনে।
তারা কিন্তু দিনের পর দিন এসেছেন। কেউ কেউ সঙ্গে ফুলও নিয়ে এসেছেন। এরা সকলেই জিসেল পেলিকটকে প্রশংসা জানাতে জড়ো হন।
তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে, কাচের দরজা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মিজ পেলিকট, তখন জড়ো হওয়া নারীদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সাহস করে তার কাছে গিয়েছেন।
কেউ আবার চিৎকার করে বলেছেন, “আমরা তোমার সঙ্গে আছি, জিসেল।”
“সাহস রাখো।”
জিসেল পেলিকটকে সমর্থন জানাতে আসা বেশিরভাগ নারীই আদালতে থেকে গিয়েছিলেন জনসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে নিজেদের আসন সুরক্ষিত করার আশায়। ওই কক্ষের টেলিভিশনের পর্দায় তারা মামলার বিচার প্রক্রিয়া দেখতে পারেন।
এদের সবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, জিসেল পেলিকটের সাহসিকতার সাক্ষী থাকা।
আদালতে চুপচাপ বসেছিলেন এই নারী, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে একজন দাদীও। আর বিচার চলাকালীন তার চারপাশে উপস্থিত ছিলেন তারই ধর্ষকরা।
আদালত চত্বরে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন বছর ৫৪-র ইসাবেল মুনিয়ার। তিনি বলছিলেন, “আমি ওর (জিসেল পেলিকট) মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই।”
“অভিযুক্তদের ব্যক্তিদের মধ্যে একজন এক সময় আমার বন্ধু ছিল। ন্যাক্কারজনক ব্যাপার।”
ওই চত্বরে উপস্থিত আর এক নারী সাদজিয়া জিমলি বলেন, “নারীবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি (জিসেল পেলিকট)।”
আদালতে জড়ো হওয়ার নেপথ্যে আরও একটা কারণ ছিল। সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মনে হচ্ছিল, তারা যেন উত্তর খুঁজছেন।
ফরাসি নারীরা (যাদের সংখ্যা শুধুমাত্র অ্যাভিগননের আদালত প্রাঙ্গণে থেমে থেকেছে এমনটা নয়) মূলত দুটো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
প্রথম প্রশ্ন হলো এই মামলা ফরাসি পুরুষদের সম্পর্কে কী ইঙ্গিত দেয়? ওই ৫০জন পুরুষদের মধ্যে সবাই একটা ছোট, গ্রামীণ পাড়ায়, অপরিচিত ব্যক্তির শয়নকক্ষে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা এক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নৈমিত্তিক আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা কিন্তু প্রথম প্রশ্ন থেকেই উঠে আসে- যৌন সহিংসতা এবং মাদক ব্যবহার করে অচেতন করার পর ধর্ষণের যে মহামারি, তার মোকাবিলা করতে এবং ‘লজ্জা’ ও ‘সম্মতি’ সম্পর্কে থাকা সংস্কার এবং অজ্ঞতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারবে কি এই মামলা?
“লজ্জার পক্ষ বদল করা উচিত” (অর্থাৎ লজ্জা ভুক্তভোগীর নয় ধর্ষকের) বলার মধ্যে দিয়ে জিসেল পেলিকট নিজের সাহসী অবস্থান এবং তার দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দিয়েছেন। তাই প্রশ্নটা হলো সেই বদল সত্যিই আসবে কি?
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার তার মামলার সাজা ঘোষণার দিন ছিল। মাদক ব্যবহার করে অচেতন অবস্থায় তাকে ধর্ষণ করার জন্য অন্য পুরুষদের উৎসাহিত করা এবং ঘটনার ভিডিও করার অভিযোগ-সহ একাধিক অভিযোগ ছিল তার স্বামী (এখন প্রাক্তন) ডমিনিক পেলিকটের বিরুদ্ধে।
আদালত ডমিনিক পেলিকটের ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য দোষী ব্যক্তিদেরও সাজা ঘোষণা করা হয়েছে।
অভিযুক্তের মুখোশের আড়ালে
একটা দীর্ঘ বিচারপর্ব তার নিজস্ব একটা বাতাবরণ তৈরি করে এবং গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, অ্যাভিগননের ‘প্যালেস দ্য জাস্টিস’- ভবনের ভিতরে একটা অদ্ভুত ধরণের স্বাভাবিকতা তৈরি হতে দেখা গিয়েছে। টিভি
ক্যামেরা আর আইনজীবীদের কোলাহলের মাঝেও ধর্ষণে অভিযুক্তদের ঝলক মিলেছে। তাদের চেহারা যে সব সময় মুখোশের আড়ালে ঢাকা ছিল তেমনটা নয়।
মামলার বিচারের শুরুর দিকে তাদের দেখতে পেলে যেমন ‘শক’ (অভিঘাত) লাগত, তেমন অনুভূতি আর হয় না।
অভিযুক্তদের ঘুরে বেড়াতে, আড্ডা দিতে, রসিকতা করতে, মেশিন থেকে কফি নিতে বা রাস্তার ওপারের ক্যাফে থেকে ফিরতে দেখা গিয়েছে। আর এই দৃশ্যগুলো কোনও না কোনওভাবে তাদের (অভিযুক্তদের) বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কৌশলগুলোর মূল যুক্তিকেই খাড়া করতে চায় যে, “এরা একেবারে সাধারণ লোক, ফরাসি সমাজের একটা ‘ক্রস-সেকশন’, যারা অনলাইনে ‘সুইঙ্গিং’ অ্যাডভেঞ্চারের (যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বিভিন্ন উপায়) সন্ধানে ছিলেন এবং অপ্রত্যাশিত একটা অবস্থার মাঝে পড়ে গিয়েছেন।”
“এটাই (এই যুক্তিই) এই মামলার সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয়। ভাবতে কষ্ট হয়,” বলেছেন এলসা লাবোহে, যিনি ‘ডেয়ার টু বি ফেমিনিস্ট’ নামে একট ফরাসি অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপে কাজ করেন।
তিনি বলেছেন, “পুরুষদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক রয়েছে এমন মানুষের মধ্যে বেশির ভাগই নিজের সঙ্গীকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবেন। তবে এখন, অনেক নারীই তার (জিসেল পেলিকটের সঙ্গে) মতোই অনুভব করেছেন। তাদের মনে হয়েছে-আচ্ছা, এমনটা তো আমার সঙ্গেও ঘটতে পারে।”
“এরা অপরাধী মাস্টারমাইন্ড নয়। ওরা শুধুমাত্র ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়েছিল… তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে সব জায়গাতেই একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।”
এই একই দৃষ্টিভঙ্গি ফ্রান্সে ব্যাপকভাবে রয়েছে, তবে ব্যতিক্রমও আছে।
ফ্রান্সের ‘ইনস্টিটিউট অব পাবলিক পলিসি’-র ২০২৪ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গড়ে ৮৬% যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এবং ৯৪% ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে হয় বিচার হয়নি বা মামলাগুলো কখনও বিচারের জন্য আসেইনি।
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মিজ লাবোহে যুক্তি দিয়েছেন যে যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটলে যখন কিছু পুরুষ জানে যে তারা “পার পেয়ে যেতে পারে। এবং তাই এটা (এ জাতীয় ঘটনা) ফ্রান্সে এত বেশি ছড়িয়ে পড়েছে বলে আমি মনে করি।”
‘দানবও নয়, সাধারণ মানুষও নয়’
চার মাসের বিচার চলাকালীন, আদালতে বিরতির সময় অভিযুক্তদের বেশিরভাগই ‘প্রেস কোর’-এর (গণমাধ্যমের) নারী সাংবাদিকদের পেরিয়ে যাওয়ার আগে মেটাল ডিটেক্টর দ্বারা পরীক্ষার জন্য জড়ো হতেন। সাংবাদিকরা অপেক্ষায় থাকতেন চেম্বারে প্রবেশের। ভিতরে ঢুকে অভিযুক্তরা নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে থাকতেন।
আদালত নিযুক্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লরেন্ট লায়েট সাক্ষ্য দিয়েছেন যে অভিযুক্তরা না “দানব” বা না “সাধারণ মানুষ”। তাদের কেউ কেউ কেঁদেছেন। কয়েকজন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
কিন্তু বেশির ভাগই নানা অজুহাত দেখিয়েছেন। অনেকে বলেছেন যে তারা কেবল “লিবার্টাইনস” (যৌন তৃপ্তির বিষয়ে যাদের কোনও ছুৎমার্গ নেই)।
ফরাসিরা বলে যেমন থাকেন যে অনেক দম্পতিরই নানান ‘ফ্যান্টাসি’ (কল্পনা) রয়েছে এবং এক্ষেত্রে তাদের জানার কোনও উপায় ছিল না যে মিজ পেলিকট মিলনের জন্য সম্মতি দেননি।
অন্যরা আবার দাবি করেছেন যে মিজ পেলিকটের স্বামী ডমিনিক পেলিকট তাদের ভয় দেখিয়েছেন।
অভিযুক্তদের চারিত্রিক দিক থেকে স্পষ্টভাবে কোনও বৈশিষ্ট্য বা মিল দেখা যায়নি। তারা সমাজে একটা বিস্তৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তির সন্তান আছে। অভিযুক্তদের অর্ধেক বিবাহিত অথবা তাদের কোনও সম্পর্ক রয়েছে। এক চতুর্থাংশের কিছু বেশি জানিয়েছেন, তারা শৈশবে নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এদের মধ্যে বয়স, চাকরি, সামাজিক শ্রেণিগত দিক থেকে শ্রেণিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। যে দুই বৈশিষ্ট্য তারা ভাগ করে নেন তা হলো, তারা পুরুষ এবং ‘কোকো’ নামে একটা অবৈধ অনলাইন চ্যাট ফোরাম মারফত যোগাযোগ করেছিলেন।
‘সুইঙ্গারদের’ পাশাপাশি শিশুদের যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং ড্রাগ ডিলারদের আকর্ষণ করে থাকে এই চ্যাট ফোরাম।
ফরাসি প্রসিকিউটরদের মতে, চলতি বছরের শুরুতে বন্ধ করে দেওয়া এই অনলাইন সাইটের সঙ্গে ২৩,০০০ এরও বেশি অপরাধমূলক কার্যকলাপের যোগ রয়েছে।
বিবিসি জানতে পেরেছে, বিচারাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩ জন বা ৪৫% পূর্ব অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। যদিও কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে না, তাও এই সংখ্যা ফ্রান্সের জাতীয় অপরাধমূলক ঘটনার গড়ের প্রায় চারগুণ।
এই সমস্ত মিলিয়ে মিজ লাবোহে যে উপসংহারে পৌঁছেছেন তা হলো, “যৌন সহিংসতায় লিপ্ত পুরুষদের কোনও সাধারণ প্রোফাইল থাকে না।”
এই মামলা বেশ কাছ থেকে অনুসরণ করেছেন যারা তাদের মধ্যে একজন হলেন ফরাসি সাংবাদিক জুলিয়েট ক্যাম্পিয়ন। তিনি পাবলিক ব্রডকাস্টার ‘ফ্রান্স ইনফোর-এ কর্মরত। সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য আদালতের বিচার-প্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি।
তার মতে, “আমি মনে করি এই মামলা অন্য দেশেও হতে পারত। তবে এটা (এই মামলা) ফ্রান্সের পুরুষরা নারীদের কীভাবে দেখেন সে সম্পর্কে অনেক কিছু বলে… বিশেষত সম্মতির ধারণা সম্পর্কে।”
“অনেক পুরুষই জানেন না যে সম্মতি আসলে কী। তাই দুঃখজনকভাবে (এই মামলাটি) আমাদের দেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই বলছে।”
‘আ ম্যাটার অব মিস্টার এভরিম্যান’
ফ্রান্স জুড়ে ধর্ষণের বিষয়ে মানুষের মনোভাবের রূপরেখা গঠনে অবশ্যই সাহায্য করছে পেলিকট মামলা।
গত ২১ শে সেপ্টেম্বর অভিনেতা, গায়ক, সংগীতজ্ঞ এবং সাংবাদিক-সহ একদল বিশিষ্ট ফরাসি পুরুষ গণ চিঠি লিখেছিলেন যা ‘লিবারেশন’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
সেখানে তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে পেলিকট মামলা প্রমাণ করেছে যে সহিংসতার ঘটনা যেখানে অভিযুক্ত একজন পুরুষ কিন্তু আদপে কোনও “দানবের বিষয় নয়।” চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “এটা পুরুষদের ব্যাপার, মিস্টার এভরিম্যানের ব্যাপার। ব্যতিক্রম ছাড়া সব পুরুষই এমন একটা ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হয় যা নারীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।”
চিঠিতে পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাওয়া পুরুষদের জন্য একটা “রোড ম্যাপ”-ও তৈরি করা ছিল। পত্রে উল্লেখ করা ছিল, “আসুন আমরা এটা মনে করা বন্ধ করি যে আমাদের আচরণকে ন্যায়সঙ্গত বলে দাবি করে এমন একটা পুরুষালি প্রকৃতি রয়েছে।”
বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন এই মামলার সঙ্গে জনস্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে।
যেমন আইনজীবী কারেন নোবলিনস্কি বলেছেন, “এই পুরো মামলা সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রজন্ম- তরুণ, অল্প বয়সী মেয়ে, প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্য দরকারি।” এই আইনজীবী প্যারিস-ভিত্তিক যৌন নিপীড়নের মামলা বিশেষজ্ঞ।
তার মতে, “এটা তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে যে ধর্ষণ সব সময় বারে হয় না, ক্লাবে হয় না। এটা আমাদের বাড়িতেও ঘটতে পারে।”
#নটঅলমেন
তবে স্পষ্টতই আরও অনেক কিছু করার আছে। এই মামলার শুরুর দিকে আমি লুই বোনেটের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি পেলিকট দম্পতির আদি নিবাসস্থল মাজানের মেয়র।
যদিও তিনি এই ধর্ষণের অভিযোগের নিন্দা করার ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থহীন ছিলেন, তবুও তাকে একটা বিষয় নিয়ে দুইবার মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল।
তার মতে, “পেলিকটের অভিজ্ঞতা অতিরঞ্জিত হয়েছে” এবং তিনি (লুই বোনেট) যুক্তি দিয়েছিলেন যে যেহেতু মিজ পেলিকট ঘটনার সময় অচৈতন্য অবস্থায় ছিলেন, তাই তিনি ধর্ষণের শিকার অন্যান্যদের তুলনায় কম কষ্ট অনুভব করেছেন।
তার কথায়, “হ্যাঁ, আমি কম হওয়ার কথা বলছি তার কারণ আমার মনে হয় এটা (ঘটনা) আরও খারাপ হতে পারত।”
“যখন (ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার ঘটনায়) শিশুরা ভুক্তভুগী হয় বা নারীদের মেরে ফেলা হয়, তখন সেটা খুবই গুরুতর হয়ে যায়। কারণ ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
“এক্ষেত্রে পরিবারকে পুনর্গঠন করতে হবে। কষ্ট হবে, কিন্তু এখানে কারও মৃত্যু হয়নি। সুতরাং, তারা এটা (পুনর্গঠন) করতে পারবেন।”
লুই বোনেটের এই মন্তব্য ফ্রান্সজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। পরে মেয়র একটা বিবৃতি জারি করে “আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।”
‘সমস্ত পুরুষই ধর্ষণ করতে সক্ষম’-এই যুক্তির উপর পেলিকট মামলা ফোকাস করছে বলে প্রচুর বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই জাতীয় দাবির সমর্থনে কোনও প্রমাণ নেই।
অনলাইন মাধ্যমে #NotAllMen (সব পুরুষরা না) হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে যুক্তির বিরোধিতা করেছেন পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ব্যক্তি প্রশ্ন তুলেছেন, “আমরা অন্য নারীদের খারাপ আচরণের জন্য বাকি নারীদের ‘লজ্জা’ বয়ে বেড়াতে বলি না, তাই শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণেই আমাদের অন্য কারও লজ্জা বয়ে যেতে হবে?”
এর বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া মিলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #NotAllMen -এর প্রতিবাদ জানিয়ে নারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং কখনও কখনও নিজেদের নির্যাতনের বিবরণ জানিয়ে জবাব দিয়েছেন।
সাংবাদিক ম্যানন মারিয়ানি লিখেছেন, “এই হ্যাশট্যাগ পুরুষরাই তৈরি করেছেন এবং তা ব্যবহারও করছেন পুরুষরাই। এটা নারীদের দুর্ভোগকে চুপ করানোর একটা উপায়মাত্র।”
পরে, একজন পুরুষ সংগীতশিল্পী এবং ইনফ্লুয়েন্সার ওয়াক্স এই হ্যাশট্যাগের সমালোচনা করেছেন। হ্যাশট্যাগ ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “চিরতরের জন্য চুপ করুন। এটা আপনার বিষয় নয়, এটা আমাদের বিষয়। পুরুষরা খুন করে। পুরুষরা আক্রমণ করে। ব্যাস।”
এলসা লাবোহে মনে করেন, ফরাসিদের মনোভাব পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। “আমি মনে করি অনেক লোক এখনও মনে করে যে যৌন সহিংসতা রোমান্টিক বিষয় বা এমন কিছু যা আমরা এখানে (ফ্রান্সে) যেভাবে চলি তারই একটা অংশ,” তিনি যুক্তি দেন।
“এই জাতীয় যুক্তি মোটেই গ্রহণ না করে তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণও।”
‘রাসায়নিক আত্মসমর্পণ’ এবং প্রমাণ
ফরাসি সাংসদ সান্দ্রিন জোসোর দফতর সেন নদীর তীরে ফরাসি পার্লামেন্ট ভবনের ঠিক পেছনে। সেই ছোট্ট দফতরে একটা ডেস্কের পাশে থাকা পোস্টারে দুই শব্দের শপথ বাক্য লিখে রেখেছেন তিনি।
সেখানে লেখা রয়েছে ‘কেমিক্যাল সাবমিশন’ (রাসায়নিক আত্মসমর্পণ) যা ইঙ্গিত করে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত মাদকদ্রব্যকে। এরই বিরুদ্ধে মিজ জোসোর লড়াই।
এক বছর আগে, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে, জোয়েল গুয়েরিয়াউ নামে এক সিনেটরের পার্টিতে গিয়েছিলেন তিনি। প্যারিসস্থিত অ্যাপার্টমেন্টে ছিল ওই পার্টি।
মিজ জোসোর অভিযোগ যে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে তার শ্যাম্পেনে মাদক মিশিয়ে দিয়েছিলেন ওই সিনেটর। মি. গুয়েরিয়াউ অবশ্য তাকে মাদক দেওয়ার বিষয়টা অস্বীকার করেছেন। তার যুক্তি ছিল এটা ‘হ্যান্ডলিং ত্রুটি’ এবং তদন্তকারীদের বলেছিলেন ওই গ্লাস ‘দূষিত’ হয়েছিল ঘটনার একদিন আগে।
এক বিবৃতিতে মি. গুয়েরিয়াউয়ের আইনজীবী বলেছেন, “সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রাথমিক প্রতিবেদন পড়ে ঘটনা সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হতে পারে, সেই অশ্লীল ব্যাখ্যা থেকে আমরা কয়েক মাইল দূরে আছি।”
আগামী বছরে এই মামলার বিচার হওয়ার কথা রয়েছে।
মিজ জোসো এখন এমন ঘটনার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন এবং ফরাসি আইনি ব্যবস্থার নিরিখে “ক্ষতিগ্রস্তদের সফর সহজ করা” তার উদ্দেশ্য।
“এটা একটা বিপর্যয়কর মুহূর্ত। কারণ প্রমাণের অভাবে অভিযোগ দায়ের করা খুব কম ভুক্তভোগীই বিচার পেতে সক্ষম হন। পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং মানসিক বা আইনি সহায়তা নেই। যৌন সহিংসতার মামলায় আমরা সর্বত্রই ত্রুটি দেখতে পাই।”
জিসেল পেলিকটের মেয়ে ক্যারোলিনের সঙ্গে মিজ জোসো উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে ‘ড্রাগ-টেস্টিং কিট’ (মাদক পরীক্ষা করা যায় এমন কিট) ফ্রান্সের ওষুধের দোকানে উপলব্ধ করানো যেতে পারে। পেলিকট মামলার আবহে এই কিট পরীক্ষামূলকভাবে দেখার জন্য সরকারি সমর্থনও পেয়েছে।
“আমি আশাবাদী। চিকিৎসা জগৎ এবং ফরাসি জনগণ চাইছে যে লজ্জা পক্ষ বদলাক (লজ্জা ভুক্তভোগীর বদলে অভিযুক্তের হোক),” জিসেল পেলিকটের বিখ্যাত উদ্ধৃতি আরও একবার তুলে ধরেছেন মিজ জোসো।
সুত্রঃ বিসিবি বাংলা