এক সকালে স্থানীয় বাসিন্দারা শুনতে পান এক বাড়িতে কান্নার শব্দ নেই, অথচ দরজা বন্ধ। পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্রী সুমাইয়া আফরিনের নিথর দেহ এবং তার মা তাহমিনা বেগমের লাশ। দুজনকেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল।
তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই বাসায় আগের দিন এসেছিল এক কবিরাজ। লোকটা নিজেকে জিন-তাড়ানো ও ঝাড়ফুঁকের ওস্তাদ দাবি করত। ধর্মীয় ছদ্মবেশে সে মানুষের ঘরে ঢুকত, গলায় তসবিহ, হাতে টুপির সাজে নিজেকে ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দিত। তাহমিনা বেগম কিছুদিন ধরে কুসংস্কারে ভুগছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন যে বাসায় অশুভ প্রভাব আছে। সেই ভরসাতেই কবিরাজকে ডেকে আনা হয়। কিন্তু সে আসলে ছিল প্রতারক। সুযোগ বুঝে সুমাইয়াকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। মেয়েকে বাঁচাতে এগিয়ে যান মা, তখনই দুজনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে ওই ভণ্ড কবিরাজ।
ঘটনার পরপরই এলাকায় শোক নেমে আসে। একটি পরিবার হারালো মা ও মেয়ে দুজনকেই। শিক্ষাঙ্গনে শোকাবহ পরিবেশ, সহপাঠীরা বিক্ষোভে নেমে বিচার দাবি করে। এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজের গভীর এক ব্যাধির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে—ভণ্ড হুজুর আর কবিরাজদের প্রতারণা।
বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যারা ধর্মীয় পোশাক পরে নিজেদের ঈমানদার ও জ্ঞানী সাজায়। তারা দাবি করে তাবিজে রোগ সারাবে, পানিতে দোয়া পড়ে ভাগ্য খুলে দেবে, আবার কেউ কেউ জিন-তাড়ানো বা অশরীরী শক্তি নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেয়। অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর কুসংস্কারের সুযোগ নিয়েই তারা মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। সরল মানুষ বিশ্বাস করে ফেলে, কিন্তু শেষে সর্বনাশই ঘটে। কোথাও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়, কোথাও নারীর ইজ্জত লুটে নেয়, আবার কখনো ঘটে ভয়াবহ খুন।
এই সমাজে পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক। পরিবারকে জানতে হবে—অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, সমস্যার সমাধান বিজ্ঞানের আলোয় খুঁজতে হবে। সমাজকে বুঝতে হবে—ভণ্ডদের হাতে ধর্মের অপব্যবহার ঠেকাতে হবে, সত্যিকারের আলেম ও শিক্ষকেরা যেন মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে, এসব প্রতারকের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এই ঘটনাটা কেবল একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য সতর্কবার্তা। ভণ্ড কবিরাজের ছদ্মবেশে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে না আসলে আরও কত পরিবার এভাবে সর্বনাশের মুখে পড়বে, তা কেউ জানে না।
