দেশের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম আনসার আল ইসলাম গোপনে সক্রিয় হয়ে উঠছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, তাদের সাংগঠনিক কাঠামোগুলো শক্তিশালী। ২০১৭ সালে সংগঠনটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপরও গোপনে তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী জঙ্গি নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে দেশের সীমান্ত এলাকায় তাদের কার্যক্রম আগের তুলনায় বেড়েছে।
আনসার আল ইসলামকে আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী বলা হয়। আনসার আল ইসলাম ভারতীয় উপ-মহাদেশের আল-কায়েদার শাখা একিউআইএসের (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কনটিনেন্ট) মতাদর্শে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক হামলায় সরাসরি অংশ নেয়।
জঙ্গি কার্যক্রমে নিয়োজিত একাধিক কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, নব্য জেএমবি, শারকিয়াসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কঠোর মনিটরিংয়ের মধ্যেও আনসার আল ইসলাম তাদের কার্যক্রম সক্রিয় রেখেছে। কারণ তারা মোবাইল ফোনে এক জন আরেক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। ডিজিটাল ডিভাইস কম ব্যবহার করে। তারা ‘কাট আউট সিস্টেমে’ (গ্রুপবদ্ধভাবে) পরিচালিত হয়। এসব কারণে তাদের শনাক্ত করা কঠিন। তারা ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হচ্ছে। টার্গেট করে হামলা করার আশঙ্কা রয়েছে। বুদ্ধিজীবী, মুক্তমনা লেখক, ব্লগারসহ নবী-রসুলদের নিয়ে যারা উলটাপালটা কথা বলেন তারাই আনসার আল ইসলামের টার্গেট হতে পারেন। চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টেনশনের মূল বিষয় হচ্ছে আনসার আল ইসলাম। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়াসহ আনসার আল ইসলামের শীর্ষ ১০ থেকে ১৫ জন নেতার কেউই এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার হননি। মাঝেমধ্যে মাঠ পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতার হলেও শীর্ষ নেতারা রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। আত্মগোপনে থেকে তারা শক্তিশালী হচ্ছে। আল-কায়দার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। এই বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য টেনশনের বড় কারণ।
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার কোনো নির্দেশনা আনসার আল ইসলাম পেয়েছে কি না, সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্প্রতি আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমের ধরন দেখে গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন আল-কায়েদা থেকে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা পেয়ে মাঠে নেমেছে তারা। বড় কিছু করার উদ্দেশ্যে পুরোনো ও বিশ্বাসযোগ্য সদস্যদের যে কোনো মূল্যে কাছে পেতে চাচ্ছে সংগঠনটি। তবে ঠিক কী নির্দেশনা আনসার আল ইসলামের কাছে এসেছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
আনসার আল ইসলাম এমনভাবে তাদের কাজ করে যে দাওয়া শাখার সদস্যরা একে অপরের পরিচয় জানতে পারেন না। এক গ্রুপের কোনো সদস্যই (মামুর) অন্য গ্রুপের সদস্য কারা, তারা কী কাজ করছেন—এর কোনো কিছুই জানতে পারেন না। তাদের সব কাজই চলে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। তাদের পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে জানেন কেবল নেতা পর্যায়ের ১০ থেকে ১৫ জন। অর্থাৎ কাট আউট সিস্টেম হলো, একটি গ্রুপে চার-পাঁচজন সদস্য থাকলে কেউ তাদের আসল পরিচয়, নাম কিংবা অন্য কোনো তথ্য জানে না। তাদের একটি টার্গেট থাকে সেই টার্গেট বাস্তবায়ন করাই তাদের কাজ। অপারেশন লেভেলের কার্যক্রমের মধ্যে তারা হয়তো বড় কোনো জঙ্গি কার্যক্রম, হামলা কিংবা টার্গেট কিলিংয়ের পরিকল্পনা করতে পারে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো মনে করছে, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি ব্যস্ত থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর ঐ সুযোগটাই বেছে নিতে চায় জঙ্গিরা। এরই অংশ হিসেবে ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে তরুণদের ‘মগজধোলাই’ করছেন জঙ্গি নেতারা। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আনসার আল ইসলাম। এদিকে আনসার আল ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত দেশে মজবুত না হওয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো হচ্ছে।
এদিকে আবারও সামনে এসেছে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার নাম। তার পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘটে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। সামনেও এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য এসেছে। কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, প্রায় এক দশকে অন্তত চার বার জিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় তার অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তবে তাকে গ্রেফতারে বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যান তিনি। জানা গেছে, মেজর জিয়া দেশেই আছেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলেও আনসার আল ইসলামের একজন সক্রিয় সদস্য। বহির্বিশ্ব থেকে তার মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করা হয়—এমন তথ্যও এসেছে।
এ প্রসঙ্গে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটসহ গোয়েন্দা বিভাগ জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে মাঠে কাজ করছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। জঙ্গিদের কোনো অপতত্পরতা চালানোর সুযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেবে না। সেইভাবে মনিটরিংসহ তৎপরতা রয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, জঙ্গিরা র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। জঙ্গিদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। তারাও সক্রিয় রয়েছে, আমরাও সক্রিয় রয়েছি।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জঙ্গিরা সক্রিয় হয়ে উঠলে আমাদের রাডারে ধরা পড়বে। আনসার আল ইসলামসহ সব জঙ্গি সংগঠনকে নিয়মিত মনিটরিং করে যাচ্ছি। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে
সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক