নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর দাওয়াতি কার্যক্রম এখনো চলছে। এই সংগঠনগুলো মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমের পাশাপাশি অনলাইনে সক্রিয়। তারা অনলাইনে প্রচারের পাশাপাশি সদস্যও সংগ্রহ করছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা নতুন করে নাশকতার সুযোগ নিতে পারে—এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সারা দেশে পুলিশ সুপারদের সতর্ক থাকতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যাবের গোয়েন্দা দল সূত্রে জানা গেছে, অনলাইনে এখনো জঙ্গি সংগঠনগুলোর দাওয়াতি কার্যক্রম চলছে। সদস্য সংগ্রহ ও উগ্রবাদী প্রচারও চলছে। সাংগঠনিক যোগাযোগের জন্য নিত্যনতুন অ্যাপস ব্যবহার করছে তারা। বিশেষ করে এ সময় আনসার আল ইসলাম অনলাইনে বেশ কিছু সদস্য সংগ্রহ করেছে।
সব শেষে তারা আদালতে হামলা চালিয়ে নিজেদের চারজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
জঙ্গি নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে পুরনো জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হুজিবি সংগঠিত হচ্ছে। অন্যদিকে এসব সংগঠনের কিছু নেতা কারাগার থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছোট ছোট দল গঠন করে দাওয়াতি কাজ চালাচ্ছেন। এদের বেশির ভাগ তৎপরতাই অনলাইনে।
অনেক ক্ষেত্রে তারা নতুন নাম দিয়ে গোপনে তরুণদের সক্রিয় করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সদস্য সংগ্রহের পর জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন শামীন মাহফুজ নামের এক জঙ্গি। এই তথ্য জানিয়ে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জেলে বসে হুজিবির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সংগঠন যাত্রা শুরু করে। এরই মধ্যে র্যাব ও পুলিশের পৃথক অভিযানে এই সংগঠনের পাহাড়ি জঙ্গি ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক ইউনিটের তথ্য মতে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
একে একে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে নিহত হন একাধিক শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই। এরপর নব্য জেএমবিসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, ২০১৭ সালের পর থেকে জঙ্গিরা বড় কোনো হামলা করতে পারেনি। পুলিশ চলতি বছরই ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বছর তারা ১৭০ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জঙ্গিবিষয়ক এক হাজার ৯৪৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৯ হাজার ৭২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে আনসার আল ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির প্রায় তিন হাজার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তাঁরা ১৬৪ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছেন। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন করে অস্তিত্ব জানান দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সরকার তথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে জঙ্গিরা। আনসার আল ইসলাম ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সম্প্রতি তাদের একটি গোপন যোগাযোগ মাধ্যমে হামলার বিষয়ে আলোচনা করার কিছু তথ্য পেয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এরই ধারাবাহিকতায় তারা অনলাইন ও অফলাইনে সদস্য সংগ্রহ করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর আলোচনায় আসা জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির কার্যক্রম একেবারে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, সংগঠনের সব শেষ আমির মেহেদি হাসান জন তুরস্কে বসে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি তুরস্কের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর নতুন কোনো আমিরের নাম শোনা যায়নি। বাংলাদেশে থাকা এই সংগঠনের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সিটিটিসির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আনসার আল ইসলাম এখনো হুমকি। জঙ্গিদের অনলাইন ও অফলাইন কার্যক্রম সব সময় নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তবে জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়লেও এখনো জঙ্গিবাদের হুমকি হয়ে আছে আনসার আল ইসলাম বা আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)। আল-কায়েদার মতাদর্শী নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির শীর্ষ নেতা বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া পলাতক। এই সংগঠনের সব সদস্যই অধিকতর উচ্চ শিক্ষিত, সচ্ছল এবং তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ।
এটিইউয়ের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এস এম রুহুল আমিন বলেন, ‘জঙ্গিবাদ একটি মতাদর্শগত বিষয়। এ নিয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।’
খোঁজ রাখছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ডের নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য দিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পবিত্র ঈদুল আজহা ও জাতীয় নির্বাচনের আগে জুনের শুরুতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ