নারায়ণগঞ্জ র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় হাজির হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্য রাইয়ানসহ চার তরুণকে আটক করেছে র্যাব। মঙ্গলবার (০৮ আগস্ট) রাতে র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তারা আত্মসমর্পণ করে।
তারা হলো নারায়ণগঞ্জ বন্দরের আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান (১৬), সিলেট ওসমানীনগরের মো. হাসান সাইদ (২৬), শেখ আহমেদ মামুন (২৩) ও মাদারীপুরের মো. ইয়াছিন (২১)।
সম্প্রতি পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে।
সুযোগ বুঝে তারা অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গত মার্চে পালিয়ে সমতলে চলে আসে। তারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে।
এ সময় তারা র্যাবের কাছে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ ও ভুল বুঝতে পারা জঙ্গিদের আইনগত সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি জানতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরিবারের উৎসাহে ও আইনগত সহযোগিতা পাওয়ার আশায় তারা র্যাব-১১ কার্যালয়ে আত্মসমর্পণ করে।
সেখান থেকে তাদের আটক করা হয়।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। তাদের পরিবার কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করে।
র্যাব নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের তথ্য পায়।
এর মধ্যে রিয়াসাদ রাইয়ান নারায়ণগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ২০২১ সালে শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরুণ ১২ জনের দলের সঙ্গে তথাকথিত হিজরত করে পাহাড়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। পালাতে গিয়ে দুইবার ধরা পড়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয় সে।
সর্বশেষ গত মার্চ মাসের শুরুর দিকে কিশোরসহ বেশ কয়েকজন পালাতে সক্ষম হয়।
র্যাব জানতে পারে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’-এর সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
কমান্ডার মঈন বলেন, ২০২১ সালে ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন কেবিন ক্রু মা। তিনি একমাত্র ছেলেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে পাঠিয়েছিলেন। পরে তিনি র্যাবের ডি-র্যাডিকালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অনুতপ্ত হয়ে ছেলেকে ফিরে পেতে গত ৯ নভেম্বর র্যাবের সহায়তা কামনাসহ গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়ে সন্তানসহ অন্য তরুণদের ফিরে আসার জন্য আকুতি জানান।
মঙ্গলবার র্যাব-১১ কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা চার তরুণ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, র্যাব-১১ পরিচয় নিশ্চিত হতে র্যাবের প্রকাশিত নিখোঁজ ৫৫ জন তরুণের তালিকায় নাম দেখতে পেয়ে তাদের আটক করে।
চার তরুণের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া ও ফিরে আসা সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, তারা বিভিন্ন সময় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়তে যোগদান করে। পরে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা তাদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কথিত হিজরতের কথা বলে বা চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ে যেতে আগ্রহী করে।
পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সহযোগিতায় সংগঠনটির সশস্ত্র প্রশিক্ষণসহ অন্য কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা দেখে তাদের ভুল ভাঙে। আরো বেশ কিছু সদস্যসহ এই চার তরুণ ফিরতে চাইলেও ফিরতে দেয়নি জামায়াতুল আনসারের সদস্যরা। বরং তাদের বন্দি রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয়।
পাহাড়ে নিয়েই তাদের জোরপূর্বক রসদ পরিবহন, রান্নাবান্না, প্রশিক্ষণের গর্ত করা, ঘর বানানোসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে বাধ্য করা হয়। ২০২২ সালের জুন মাসে সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে রনি পাড়া এসে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা খোঁজার সময় কেএনএফ সদস্যদের কাছে ধরা পড়ে চার তরুণ। জঙ্গি ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বন্দি রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।
হাসান সাঈদ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, সিলেটের ওসমানীনগরের স্থানীয় মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করা হাসান সাঈদ ২০২১ সালে শুরা সদস্য মায়মুনের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়ায়। ২০২১ সালের নভেম্বরে শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে পাহাড়ে যায়। পাহাড়ে যাওয়ার পর সাঈদেরও অন্য তরুণদের মতো ভুল ভাঙে। দুইবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়।
শেখ আহমেদ মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিল। ২০২১ সালে সাঈদের মাধ্যমে জামায়াতুল আনসারে যোগ দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে সাঈদ বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে পাহাড়ে যায়।
ইয়াসিন ছিল মাদারীপুরের একটি দোকানের ঘড়ি মেকানিক। সিরাজের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ২০২১ সালের নভেম্বরে পাহাড়ে যায়। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে সে ভুল বুঝতে পারে এবং সমতলে ফিরে আসে।
কুকি-চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠনের পরিত্যক্ত একটি ক্যাম্প থেকে দুই জঙ্গি সদস্যের লাশ উদ্ধার সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পাহাড়ে তিনটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল। এই তিনটি ক্যাম্পের একটি থেকে হোমিও চিকিৎসক ডাক্তার আহমেদ ও রাইয়ানের গৃহশিক্ষক আল আমিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আজ আত্মসমর্পণ করা এই চারজন আলাদা ক্যাম্পে থাকায় সরাসরি হত্যার ঘটনা দেখেনি। তবে তারা অন্য সদস্যদের মাধ্যমে জেনেছে, বিভিন্ন সময়ে কেএনএফের সঙ্গে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘর্ষ হতো। আবার নিজেরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে যেত।
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ