হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ (এবিটি)। ২০১৩ সালের পর থেকে একের পর এক লেখক-ব্লগারসহ প্রগতিশীল ব্যক্তিকে হত্যা এবং হামলার নিশানা করে দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবিটি। ভয়ংকর এই জঙ্গি সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রাহমানী ১১ বছর কারাবন্দি থাকার পর গত রোববার জামিনে বেরিয়ে গেছেন । এতে ফের সংগঠনটি চাঙ্গা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কারামুক্তির পর থেকে রাহমানী নিরুদ্দেশ বলে দাবি করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এখন এবিটির তিন শীর্ষ নেতাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্য দু’জন– মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও আরেক আধ্যাত্মিক নেতা তামিম আল আদনানী।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এবিটির সদস্যরা এতে নেতৃত্ব দেয়। ছিনিয়ে নেওয়া ওই দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফীন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। আনসার আল ইসলাম নামেও কার্যক্রম চালায় এবিটি।
রাহমানীর নিরুদ্দেশ হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তার কারামুক্তির বিষয়টি আমরা জেনেছি। দ্রুত তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তার মতো উগ্রপন্থি সংগঠক বাইরে থাকায় নানা ঝুঁকি রয়েছে। তার মুক্তির মধ্য দিয়ে এবিটির সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের চাঙ্গা ভাব এসেছে। যেসব অ্যাপে তারা গোপনে যোগাযোগ করছে, তা নজরদারি করে রাহমানীর জামিনের পর তার অনুসারীদের তৎপরতার নানা তথ্য মিলছে।
জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ওপর এক যুগের বেশি খোঁজ রাখছেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, রাহমানীর বিরুদ্ধে ৬টি মামলা ছিল। প্রথম মামলাটি হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এ ছাড়া ব্লগার রাজীব হায়দার ও আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর বাইরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা তিনটি মামলার আসামি রাহমানী। এসব মামলার মধ্যে একটিতে তাঁর সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। অন্য পাঁচটি মামলায় তিনি জামিনে আছেন।
পুলিশ ও কারা সূত্র বলছে, রাহমানী সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে একটি মামলায় জামিন পান। এর আগে বরগুনা জেলার একটি, রাজধানীর গুলশান থানা, উত্তরা-পশ্চিম থানার একটি করে এবং মোহাম্মদপুর থানার দুটি মামলায় জামিন নেন তিনি। গত রোববার গাজীপুরের কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান রাহমানী।
২০১২ সালের দিকে নতুন আদলে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করেছিলেন রাহমানী। তাঁকে এবিটির ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করেন উগ্রপন্থিরা। হাতেমবাগ মসজিদে বয়ানের আড়ালে উগ্রপন্থিদের উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। জঙ্গিবাদ উস্কে দিতে পারে– এমন বেশ কিছু বইও লিখেন তিনি। এর মধ্যে ‘দ্বীন কায়েমের পথ’ ও ‘উন্মুক্ত তরবারি’ নামে দুটি বই আছে। মূলত ২০১৩ সালে মেজর (বরখাস্ত) জিয়া যুক্ত হওয়ার পর এবিটি সাংগঠনিক ভিত্তি পায়। দীর্ঘদিন ধরে জিয়া পলাতক।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আদালত খেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন রাহমানী। সংগঠনের যেসব সদস্য এর নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের অনেকের সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল তাঁর। কারাগারের বাইরে থাকলে এবিটিতে নতুনভাবে সদস্য রিক্রুট বাড়তে পারে। এবিটির আরেক আধ্যাত্মিক নেতা তামিম আল আদনানী পলাতক থাকায় তাদের যোগাযোগ বাড়বে।
২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার হন রাহমানী। শহরের উপকণ্ঠে দক্ষিণ খাজুরতলা এলাকার জলিল মাস্টারের বাড়ি থেকে গোপন বৈঠক চলাকালে রাহমানীসহ ৩১ জনকে আট করে পুলিশ। এর পর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীতে বাসার সামনে রাজীবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রায়ে এবিটির দুই জঙ্গিকে ফাঁসি, চারজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড, একজনকে তিন বছরের এবং রাহমানীকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন নিম্ন আদালত। রাজীব হত্যায় উস্কানিদাতা হিসেবে তাঁর সাজা হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতেও ওই সাজা বহাল থাকে। এরই মধ্যে রাহমানীর সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে।
জসীমুদ্দীন রাহমানীর বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার দক্ষিণ হেউলিবুনিয়া গ্রামে। তিনি বরগুনা শহরের ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পাস করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৯০ সালে প্রথম দাওরা পাস করে তিনি ভারতের দেওবন্দে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তী সময়ে হায়দরাবাদের সাবেলুস সালাম মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। বিভিন্ন সময় ঢাকা ও বরিশালের একাধিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা এবং মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে কয়েক বছর সৌদি আরবে থাকার পর দেশে ফিরে আসেন। এর পর ধানমন্ডির একটি মসজিদের খতিব হন। তিনি মোহাম্মদপুরের বছিলায় ‘মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া’ নামে একটি এনজিওর পরিচালক হন। সেই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে ওয়াজ, জুমার নামাজের খুতবা, বই ছাপিয়ে ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে উগ্রবাদ বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখেন।
জানা গেছে, এবিটির আরেক আধ্যাত্মিক নেতা তামিম আল আদনানী নিয়মিত অনলাইনে আনসার আল ইসলামের সদস্যদের উদ্দেশে জঙ্গি মতবাদ প্রচার করে আসছেন। সংগঠনের অপারেশনাল কমান্ডার পলাতক জিয়াকে নিয়ে দল গোছাচ্ছেন আদনানী। বর্তমানে দাওয়াতি কার্যক্রমে বেশি মনোযোগী তারা।
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ