প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু খোঁজ মেলেনি পুরনো ঢাকার আদালত পাড়া থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই দুই জঙ্গির। তারা কোথায় আছে, দেশে নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে—কোনও হদিস জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও ইউনিট। অবশ্য তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের জন্য নানা কৌশলে অভিযান চালানো হচ্ছে। গত সপ্তাহেও ঢাকার বাইরে পৃথক দুটি অভিযান চালানো হয়েছে। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।
২০২২ সালের ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ আদালত এলাকা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) নেতা মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা। ছিনিয়ে নেওয়া ওই দুই জঙ্গিই প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, আলোচিত এই ঘটনায় পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কারাগারে বন্দি থাকা শামীম ও সোহেলের সহযোগীরাও রয়েছে। এছাড়া আবু সিদ্দিক সোহেলের স্ত্রী শিখাসহ পালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়া আরাফাত রহমান ও আব্দুস সবুরসহ সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। শিখা ও বখতিয়ার নামে দুজন জঙ্গি ছিনতাইয়ে সহযোগিতা ও পালানোর পরিকল্পনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের পরিদর্শক আজিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করছি। গত দুই সপ্তাহে ঢাকার বাইরে একাধিক জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তাদের অবস্থান শনাক্তের পর নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু ঘন ঘন স্থান বদলের কারণে তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী—এই দুই জঙ্গি এখনও দেশেই অবস্থান করছে।’ অতি দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
‘এএআই সদস্যদের ধরা অনেক কঠিন’
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন এএআই বা আনসার আল ইসলামের সদস্যদের অবস্থান শনাক্ত করা এবং তাদের গ্রেফতার করা অনেক কঠিন এবং দীর্ঘ সময় লেগে থাকতে হয় বলে জানান দীর্ঘদিন জঙ্গি প্রতিরোধে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে এএআই সদস্যরা আলাদা। আনসার আল ইসলামের সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও ডেডিকেশন অনেক বেশি। তারা তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়েও বেশি দক্ষ। তারা কাট-আউট পদ্ধতিতে সংগঠন চালায়। ফলে সহজেই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভবও নয়।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর অব. সৈয়দ জিয়াউল হক এমনভাবে সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পরিচালনা করেন, যারা নিজেরাই অনেক বেশি সতর্কতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের রেকি করে চলাফেরা করে। এ কারণে জিয়াকে কয়েকবার গ্রেফতারের কাছাকাছি গেলেও ধরা যায়নি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ইমরান হোসেন ইমন বলেন, ‘ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। নিয়মিত অভিযান চলছে। কিন্তু আনসার আল ইসলাম সদস্যদের ধরতে একটু সময় লাগে। দীর্ঘ সময় লেগে থাকতে হয়। আমরা শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনতে পারবো।’
জঙ্গি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা
সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের আনা-নেওয়ার বিষয়ে একটি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে—‘জঙ্গি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পরিপত্র আক্ষরিক অর্থে প্রতিপালন করতে হবে। বিশেষ করে আসামি পরিবহনের জন্য দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে বিশেষ ব্রিফিং প্রদান করেন, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। এছাড়া যে ইউনিট আসামিকে স্কর্ট করে আদালতে নিয়ে আসার দায়িত্বে থাকবে, সেই ইউনিটের পুলিশ সদস্যরা আসামি গ্রহণকারী ইউনিটের সদস্যদের কাছে আসামিকে বুঝিয়ে দেবে। এরপরও তারা গ্রহণকারী ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে আসামিদের নিরাপত্তার ডিউটিতে মোতায়েন থাকবে। এটিইউ, সিটিটিসি, এসবি, সিআইডিসহ যেসব পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম নিয়ে কাজ করে, এসব ইউনিটের এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। এই সেল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন সংক্রান্ত পুলিশি কার্যক্রম, যেমন—গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অপারেশন, গ্রেফতার, তদন্তে সহায়তা, প্রসিকিউশন বিভাগকে সহায়তা ও আসামি পরিবহনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমন্বয় করবে।’
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত ডিআইজি নাসিয়ান ওয়াজেদের সই করা ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘প্রিজন ভ্যানগুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগানো যেতে পারে। এতে প্রিজন ভ্যানের ভেতরে আসামিদের গতি-প্রকৃতি মনিটরিং করা সম্ভব হবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রিজন ভ্যানে পরিবহন করা যেতে পারে। এখন ডিএমপির সিএমএম কোর্টের হাজতখানার দায়িত্বে একজন সাব-ইন্সপেক্টর ইনচার্জ হিসেবে কাজ করেন। তার পরিবর্তে হাজতখানায় একজন সহকারী পুলিশ সুপার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যেতে পারে। ঢাকাসহ সারা দেশের আদালতে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের কর্তব্য সুস্পষ্ট করাসহ নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আদালত প্রাঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরও বেশি সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও মনিটরিং করতে হবে। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধনপূর্বক ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাজাপ্রাপ্ত বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষেত্রে আদালতে অনলাইনে হাজিরা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ আসামিদের কাশিমপুর কারাগারের বদলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা যেতে পারে।
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন