প্রথম দর্শনে ৩২ বছর বয়সী এই যুবককে দেখে খুবই শান্তশিষ্ট মনে হবে। তবে হারিস ফারুকীকে বাইরে থেকে দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে না যে তিনি বিশ্বের সবথেকে বিপজ্জনক জঙ্গী সংগঠন তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ভারতের প্রধান।
পুলিশ জানিয়েছে, ১২ বছর আগে দেরাদুনের ডালনওয়ালা থেকে পড়াশোনার জন্য আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন হারিস ফারুকী ওরফে হারিস আজমল ফারুকী। সেই থেকে আর কখনও তিনি বাড়ি ফেরেন নি।
প্রায় ২০ বছর আগে হারিসের পরিবার দেরাদুনে বসবাস করতে শুরু করে। তার বাবা আজমল ফারুকী দেরাদুনের একজন ইউনানি হাকিম।
হারিস ফারুকীরা তিন ভাই ও দুই বোন। কিন্তু গত ১২ বছরে তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাঁর অন্য আত্মীয়রা থাকেন শহরের সিঙ্গল মান্ডি এলাকাতে।
আইএস-এর ভারতের প্রধান হারিস ফারুকীকে আসাম পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বুধবার ভোরে গ্রেপ্তার করেছে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আসামের ধুবড়ি শহর থেকে হারিস ফারুকী ও তার অন্যতম সহযোগী অনুরাগ সিং ওরফে রেহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
হরিয়ানা রাজ্যে পানিপথের দিওয়ানা নামে একটি এলাকার আদি বাসিন্দা রেহান। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তার স্ত্রী বাংলাদেশি নাগরিক, এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ।
যেভাবে ধরা পড়লেন মি. ফারুকী
ভারতে আইএসের হয়ে কাজ করা নেতাদের এটিই সবথেকে বড় গ্রেপ্তার বলে মনে করা হচ্ছে।
এই দুই আইএস সদস্যকেই দিল্লি, মুম্বাই ও লখনউয়ের ঘটনায় জাতীয় সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএ খুঁজছিল।
হারিস ফারুকী যখন ধরা পড়েন, তখন তিনি ও তার এক সহযোগী বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আসামের ধুবড়ি শহরের ধর্মশালা এলাকায় একটি গাড়ি খুঁজছিলেন।
তখন ভোর সোয়া চারটে নাগাদ। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুই জঙ্গী নেতা গভীর রাতে নদীপথে প্রতিবেশী দেশ থেকে ধুবড়ি পৌঁছিয়েছিলেন এবং তাদের গন্তব্যের দিকে রওনা হতে যাচ্ছিলেন।
আসাম পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বা এসটিএফের আইজি পার্থসারথি মহন্ত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “১৫ দিন আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আমাদের কাছে এই ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য ছিল। ধুবড়ির কয়েকটি এলাকা দিয়ে আইএসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে যাওয়া হতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা আমরা জানতে পারি।”
“তথ্য খুবই নির্ভরযোগ্য ছিল। তার ভিত্তিতেই একটি টিম তৈরি করে তাদের ধরার পরিকল্পনা করে এসটিএফ। আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ১৮ই মার্চের মধ্যে তাদের আসার কথা ছিল, তবে ১৯-এ মার্চ আমরা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে খুব সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়,” জানাচ্ছিলেন মি. মহন্ত।
তার কথায়, “আমাদের কাছে এই দুই জঙ্গীর ছবি ছিল এবং ধুবড়ির ধর্মশালা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে এই দুই জঙ্গীকে এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।“
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হারিস ফারুকী প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়তেন। সেখানে তিনি তরুণদের মানসিকতা যাচাই করে অনেককে তার সংগঠনে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
এই দুই আইএস জঙ্গীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আসাম পুলিশ, যেখান থেকে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।
আইজি পার্থসারথি মহন্ত বলেন, “হারিস ফারুকী খুব ধূর্ত এবং শিক্ষিত। তিনি তার কথার মারপ্যাঁচে মানুষকে ফাঁদে ফেলতে পারেন। তিনি খুব সহজেই মানুষকে অনুপ্রাণিত ও মগজ ধোলাই করতে পারেন। তাই ভারতে আইএস অভিযানের নেতৃত্ব দিতে গেলে একজনকে এরকমই অভিজ্ঞ হতে হবে।”
আইজি মি. মহন্ত বলেন, “আইএস অভিযানের প্রধান হিসেবে তিনি সংগঠনে যুবকদের নিয়োগের কাজ করছিলেন।”
”ফারুকী একজন রিক্রুটিং এক্সপার্ট এবং প্রচারেও পারদর্শী। যেমন অনুরাগ সিংয়ের উদাহরণই দেখুন। ফারুকীর মগজ ধোলাইয়ের কারণেই অনুরাগ থেকে রেহান হয়েছেন তিনি।”
এ ছাড়া আইইডি বিস্ফোরণের ঘটানো ছাড়াও তহবিল সংগ্রহ আর সেসবের ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী এবং তার সব ধরনের প্রশিক্ষণ রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
তবে পুলিশের দেয়া এসব তথ্য অন্য কোন সূত্রে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।
আসামে আইএস নেতা ফারুকীর গ্রেফতারির পর দেরাদুনের সিনিয়র পুলিশ সুপার অজয় সিং সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেন, “হারিস ফারুকী গত ১০-১২ বছর ধরে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেননি, তাঁর পরিবারের কাছে কোনও যোগাযোগের নম্বরও নেই।”
“তিনি কোথায় আছেন, কী করেন, সে বিষয়ে পরিবারকে কিছু জানাননি। এর আগে অক্টোবর মাসে বিভিন্ন সংস্থা ও জেলা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া হয়,” জানিয়েছেন মি. সিং।
“আমরা সেই সব তথ্য যাচাই করার জন্য তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি। কিন্তু জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত থাকার কারণে পরিবারের কোনও সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তিনি,” বলছিলেন অজয় সিং।
সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ভারত থেকে আইএসে মোট ২৬১ জন ‘রিক্রুটার’ ও সমর্থক যোগ দিয়েছে।
এ পর্যন্ত ১১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ৬০ জনকে আটক করা হয়েছে। ভারত থেকে ২০১৭ সালের ৩১এ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৮ জন সিরিয়া ও ইরাকে গেছেন, যাদের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে
আইএসে যোগ দেওয়ার পর এই প্রথম হারিস ফারুকীকে পুলিশ ধরতে পারল।
প্রায় চার বছর নিখোঁজ থাকার পরে ৩৮ জন ভারতীয় নির্মান শ্রমিকের দেহ মুম্বাইতে ফিরিয়ে আনার পরে সেখানে প্রতিবাদ। ওই ৩৮ জনকে আইএস জঙ্গীরাই মেরে ফেলে।
প্রায় চার বছর নিখোঁজ থাকার পরে ৩৮ জন ভারতীয় নির্মাণ শ্রমিকের দেহ মুম্বাইতে ফিরিয়ে আনার পরে সেখানে প্রতিবাদ। ওই ৩৮ জনকে আইএস জঙ্গীরাই মেরে ফেলে। – ২০১৮ সালের ছবি
হারিস ফারুকীর পরিবারে কে কে আছেন?
দেরাদুনের সিনিয়র পুলিশ সুপার অজয় সিং বলছিলেন, ” পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দেরাদুন পুলিশ ক্রমাগত তার বাড়িতে গিয়ে যাচাই করেছে। প্রত্যেকবারই জানতে পেরেছি যে তিনি বছরের পর বছর ধরে দেরাদুনে ফিরে আসেননি বা তার পরিবারের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই।
“আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর থেকে গত ১০-১২ বছর ধরে হারিস আর বাড়ি ফেরেননি। হারিসের বিভিন্ন যোগসূত্র নিয়ে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি সমস্ত তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ও করা হয়েছে।“
অজয় সিংয়ের কথায়, “আজমল ফারুকীর ছয় সন্তানের মধ্যে হারিস দ্বিতীয়। তার বড় ভাই গ্রাফিক্স এবং নির্মাণ ব্যবসায় রয়েছেন, এক ছোট ভাই হায়দরাবাদ থেকে পিএইচডি করছেন, এবং তৃতীয় ভাই দেরাদুনে এনআইটির প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
“হারিসের এক বোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যজন একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। হারিস বিবাহিত এবং তার স্ত্রী বিহারের বাসিন্দা।
আদতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা হলেও হারিস ফারুকীর পরিবার দেরাদুনে থাকে,” জানিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
হারিসের বাবা সরকারি দফতরে হাকিম হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তবে এখন তিনি অবসর নিয়েছেন।
সুত্র” বিবিসি বাংলা