বিশ্বজুড়ে বেড়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি লিঙ্গবৈষম্য। বিশেষ করে সহিংসতা ও শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রে আইনি অধিকারে বড় তারতম্য বিদ্যমান। সামগ্রিকভাবে পুরুষদের দুই-তৃতীয়াংশেরও কম অধিকার ভোগ করেন নারীরা।
একজন নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার ব্যাপারে সহকর্মীদের সংবেদনশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, এর ফলে কর্মক্ষমতা ও দক্ষতাকে তিনি আরও বেশি কাজে লাগাতে সক্ষম হন। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নারী যতটা সহনশীল ও সহমর্মী-সহকর্মী পান, সেই কর্মক্ষেত্রে নারী ততটাই স্বাচ্ছন্দ্যভাবে কাজ করতে সক্ষম হন। একজন নারীকে ঘর ও বাইরে দুটোই সমানভাবে সামলাতে হয়। পারিবারিক সম্পর্ক থেকে সামাজিক সম্পর্ক দুটোই তাঁকে সমান তালে দেখতে হয়। হয়তো একজন পুরুষ অফিসে যাওয়ার সময় তাঁর টাই বেঁধে দেওয়া বা মুখে নাশতা তুলে দেওয়ার জন্য আরেকজন মানুষ পাশে পান, যিনি তাঁর মা, বোন বা স্ত্রী; কিন্তু একজন নারীকে ৯টায় অফিস ধরতে ভোর ৫টায় উঠে সংসারের সব কাজ সামলে পরিবারের সবার নাশতা বা দুপুরের খাবারের জোগান দিতে হয়। তারপর হয়তো তাঁকে অফিসের পথে রওনা হতে হয়। কর্মস্থলে যদি বৈরী আচরণের শিকার হতে হয়, ওই নারীর জন্য তা হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্নের মতো।
সদ্য স্নাতকোত্তর পাস করে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ শুরু করেন রীতা (ছদ্মনাম)। প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটিভ হেড তাঁকে বলেছিলেন, ‘যাদের প্রতি মাসে তল দিয়ে রক্ত যায়, সে আবার কী সৃজনশীল কাজ করবেন!’ রীতার ‘অপরাধ’– পিরিয়ডের সময় তিনি শুটিংয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে খোলাখুলি জানিয়েছিলেন। এ সময় তিনি ডেস্কের কাজ করবেন; কারণ তখন তাঁর তীব্র পেট ব্যথা হয়।
এটা তো গেল সহকর্মীদের ব্যবহার। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ করে। একটি প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন চ্যানেলে সহকারী প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করেন শিমু (ছদ্মনাম)। তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবের পর নির্ধারিত ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসা। এই পুরো সময় প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ থেকে বাজে আচরণের শিকার হতে হয় তাঁকে। শিফট ডিউটি থাকার কারণে তাঁকে টানা নাইট শিফটে ডিউটি দেওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের খারাপ ও অসহযোগিতামূলক আচরণ এবং কিছু পুরুষ সহকর্মীর বাজে ব্যবহার ছিল প্রায় নিত্যকার ঘটনা। চার মাস বয়সী সন্তানকে রেখে তিনি কাজে যোগদান করেন এবং সন্তান যেহেতু ছোট ও ব্রেস্ট ফিডিংয়ে অভ্যস্ত ছিল– তাঁকে এ বিষয়টি মানসিক ও শারীরিকভাবে এতটাই অসুস্থ করে ফেলে, তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। একজন প্রতিশ্রুতিশীল গণমাধ্যমকর্মী, যিনি ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে পারেননি। এর মূল কারণ, কর্মস্থলের অসহযোগী আচরণ ও মনোভাব। তেমনি এক নারী ক্যামেরাপারসনকে পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে অনেক ধরনের ট্রল ও হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডিগ্রি অর্জন করা ওই নারীকে সন্তান জন্মদানের পর বাধ্যতামূলক নাইট শিফট দেওয়া হয়। বিষয়গুলো মানবিক ও সংবেদনশীলভাবে দেখতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।
আবার এর উল্টো চিত্রও দেখা যায়। একজন গণমাধ্যমকর্মী সহকর্মীদের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি জানান, সন্তানসম্ভবা হওয়ার দিনটি থেকে সন্তান জন্মদান ও পরবর্তী সময়ে সহকর্মীরা তাঁকে সবসময় যে সাহায্য করেছেন, সহমর্মিতা দেখিয়েছেন; জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা মনে রাখবেন।
একটি নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র শুধু নারী নয় বরং পুরুষের জন্যও একটি আনন্দময়; সুখী কর্মপরিবেশ তৈরি করে। এক নারী তাঁর কর্মক্ষেত্রের কথা বলতে গিয়ে আফসোস করে বলেন, ‘১০০ শতাংশ কর্মস্পৃহার ৮০ শতাংশ আমি ব্যয় করি আমার কাজটি করার পথে সবার অসহযোগিতা ও অফিস রাজনীতি ঠেকাতে। কেননা, আমার পেশায় থাকা পুরুষ সহকর্মীরা আমার সামনে এগিয়ে যাওয়াকে তাদের ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি বলে মনে করেন।’ পেশায় ব্যাংকার সুমিতা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘একসময় ভাবতাম নারী বস হলে সহযোগিতা পাব; সেখানেও ভিন্ন চিত্র। বরং পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবপুষ্ট নারী সহকর্মীরা আরও ভয়ংকর হন।’
আজকের আধুনিক নারী বাইরে বের হচ্ছেন, কর্মক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। তাদের ক্ষমতায়ন ঘটছে। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, একটি অদৃশ্য গ্লাস সিলিংয়ের ঘেরাটোপে তারা ঘুরপাক খান। নীতিনির্ধারণী জায়গায় তাদের পৌঁছাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। উচ্চপদস্থ নারীদের আমরা খুব কম দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নীতি ও কর্মপরিবেশ একটি অন্যতম কারণ। তাই আমাদের দেশে নারীরা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হলেও নারীর ক্ষমতায়ন এখনও অনেক ক্ষেত্রে সুদূরের চিত্র। নীতিগত ও আচরণগত এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই নারীর সামনে এগিয়ে চলার পথ রচিত হতে পারে।
সুত্রঃ সমকাল