অনেক নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েও অভিযোগ জানাতে পারেন না।
একজন নারীর নাম ধরুন আকলিমা আক্তার। এটি অবশ্যই তার ছদ্মনাম।
বেশ কয়েক বছর আগে তিনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ছিলেন সেখানকার এক শিক্ষক একবার তাকে নিজের কক্ষে ডাকেন।
রুমে ঢোকার পর সে শিক্ষক তাঁকে অতর্কিতে জড়িয়ে ধরেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যান সে ছাত্রী।
নিজেকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন সে ছাত্রী।
নিজের এ দু:সহ পরিস্থিতির কথা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে প্রকাশও করেছেন তিনি।
তাদের মধ্যে কেউ-কেউ তাকে অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে কোথায় অভিযোগ করতে হবে? কার কাছে অভিযোগ করবেন?
অন্য শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করলে তারা যদি তাকে খারাপ মনে করে?
ইত্যাদি বিষয় ভাবতে-ভাবতে সপ্তাহ গড়িয়ে যায়।
তাছাড়া ঘটনাটি প্রকাশ না করতে পরিবাররে দিক থেকে তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে তথাকথিত মানসম্মানের ভয়।
আকলিমার মতো এ রকম আরো অনেকে আছেন, যারা কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হলেও নীরবে সেটি সহ্য করে যান।
অভিযোগ নিয়ে কিভাবে অগ্রসর হতে হবে সেটি তারা বুঝে উঠতে পারেন না।
যৌন হয়রানির প্রতিকার
কর্মস্থলে যৌন হয়রানীর প্রতিকার পাবার জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। সেখানে বলা আছে, কোন প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানীর অভিযোগ উঠলে সেটি তদন্ত এবং প্রতিকার পাবার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
কিন্তু কর্মজীবী নারীদের প্রায় ৬৫ শতাংশ হাইকোর্টের এই নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক গবেষণায় এ কথা বলা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রায় ৮০ শতাংশ এ বিষয়টি নিয়ে অবগত নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে একটি কমিটি থাকার কথা, সেখানে নারী সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। সে কমিটির যে কোন সদস্যের কাছে অভিযোগ করা যাবে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে যিনি অভিযোগ করছেন এবং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে – উভয়ের নাম গোপন রাখতে হবে। কমিটি উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবে।
“যিনি অভিযোগ করেছেন, তিনি যদি মনে করেন যে বিষয়টা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়, তাহলে সেটা করা সম্ভব। যদি তিনি মনে করেন যে এটা সম্ভব না, এটা গুরুতর বিষয় তাহলে কমিটি পুরো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার সুপারিশ করবে,” বলছিলেন সারা হোসেন।
এরপর কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিতে পারবে। এটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কেউ যদি মনে করে যে তিনি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাননি তাহলে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে কোন পক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
সারা হোসেন বলেন, এর বাইরে গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে ভিকটিম পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।
তিনি বলেন, নারীদের উপর হয়রানির বিষয়গুলো অনেক প্রতিষ্ঠান সিরিয়াসলি না নেওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে না।
অভিযোগ দায়েরে অনাগ্রহ
বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত তদন্ত সেল রয়েছে সেগুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য় অন্যতম।
জোবাইদা নাসরিন
এই যৌন নিপীড়ন সেলের একজন সদস্য অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, যৌন নিপীড়ন সেলের সামনে নানা ধরণের অভিযোগ আসে।
তিনি বলেন, অনেকে তার কাছে মৌখিকভাবে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। কিন্তু তাদের অনেকে অভিযোগ লিখিত আকারে উত্থাপন করতে চায়না বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক নাসরীন।
তিনি বলেন, “অনেকে মনে করে যে অভিযোগ উত্থাপন করলে শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা পরবর্তীতে চাকরি পেতে সমস্যা হবে। তাছাড়া অনেকের পরিবারও চায়না যে বিষয়গুলো প্রকাশ হোক।”
নারীরা এসব বিষয় চিন্তা করে সবসময় অভিযোগ দায়ের করতে চায়না বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক নাসরীন।
যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠলে অনেক সময় বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে সে বাধ্যতামূলক ছুটিকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অধ্যাপক নাসরীন বলেন, বাধ্যতামূলক ছুটি কোন শাস্তি হতে পারেনা।
অ্যাকশন এইড-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, একজন কর্মজীবী নারীকে তার প্রতিষ্ঠানের নীতি সম্পর্কে জানতে হবে। যৌন হয়রানী সংক্রান্ত অভিযোগ আসলে সেগুলো কোথায় এবং কিভাবে উত্থাপন করতে হবে, সে বিষয়টি প্রত্যেকটি নারী কর্মীকে তার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
ফারাহ কবির বলেন, যৌন হয়রানির শিকার হলে নারীদের অবশ্যই অভিযোগ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
তিন বলেন, অভিযোগ দায়ের না করলে অপরাধীরা অনায়াসে পার পেয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে আবারো অন্যজনের সাথে একই অপরাধ করবে।
সুত্রঃ বিবিসি বাংলা